বর্তমান বিশ্বে ১৯৫টি স্বাধীন দেশ আছে। এদের মধ্যে অর্থ ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে সব গুলো দেশকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় যেমন উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত। উন্নত দেশগুলো তাদের ক্ষমতা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুরো বিশ্ব শাসন করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রযুক্তির সহায়তায় ধিরে ধিরে উন্নত দেশের তালিকায় নিজের যায়গা করে নিচ্ছে। তবে আজকে আমরা আলোচনা করবো বিশ্বের শীর্ষ ১০ টি ধনী দেশ সম্পর্কে। যারা অর্থ এবং সামর্থ্যের দিক দিয়ে পুরো বিশ্বে সবার প্রথমে অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি প্রতিটি দেশের জিডিপির তথ্য প্রকাশ করেছে। যার উপর ভিত্তি করে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন ১০ টি ধনী দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। তাহলে চলুন দেশগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
সাধারণত কোন দেশ কেমন ধনী তা নির্ভর করে তার পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) এবং জিডিপির উপর। তো চলুন দেখে নেওয়া যাক কোন কোন দেশ বর্তমানে বিশ্বের সব থেকে ধনী দেশ।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
কাতার
কাতার ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালে। তখন পর্যন্ত কাতার একটি দরিদ্র দেশ ছিল। কারণ কাতার অন্যান্য আরব দেশের মতই শুষ্ক এবং মরুভূমি এলাকা। এতে কোন ভূগর্ভস্থ পানির উৎস নেই যার কারনে এখানে গাছপালা এবং পশুপাখি অনেক কম।
কাতারের মোট আয়তন ১১,৫৮১ স্কয়ার কিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ২,৬৭৫,৫২২ জন। কাতারের প্রধান আয়ের উৎস হলো এদের তেল ইন্ডাস্ট্রি। অর্থাৎ কাতারের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে এই তেল শিল্পের গুরুত্ব সবথেকে বেশি।
বর্তমানে পিপিপি জিডিপি হিসেবে কাতারের মাথাপিছু আয় ১,৩২,৮৮৬ ডলার। এই বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক ডলারের কারনে কাতার বর্তমান বিশ্বে সবথেকে ধনী দেশ।
ম্যাকাও
ম্যাকাও বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী দেশ। এটি হংকং এর মতই চিনের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। তবে এদের নিজস্ব পার্লামেন্ট এবং পতাকা আছে। ম্যাকাও এর মোট আয়তন ২৯.৫ স্কয়ার কিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা ৫,৬৮,৭০০ জন।
ম্যাকাও কে জুয়ার স্বর্গ বলা হয় কারণ এখানে অনেকগুলো লিগ্যাল ক্যাসিনো আছে। এখানে অবাধে জুয়া খেলা যায় এবং ম্যাকাও এর অন্যতম আয়ের উৎস হলো জুয়া। এছাড়া এখানে অনেক পর্যটক আসে যেখান থেকে তাদের মোট আয়ের কিছু অংশ পূরণ হয়।
এসবের পাশাপাশি তাদের প্রধান আয়ের উৎস যন্ত্রাংশ উৎপাদন করা। পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী ম্যাকাও এর মাথাপিছু আয় ১,১৪,৩৬৩ ডলার। ম্যাকাও বিশ্বের ধনী দেশ গুলোর মধ্যে দ্বিতীয় নাম্বারে আছে।
লুক্সেমবার্গ
লুক্সেমবার্গ একটি ছোট দেশ যা ইউরোপে অবস্থিত। এই দেশকে জার্মানি, ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। লুক্সেমবার্গকে দুর্গ এবং ব্যাংকের দেশ বলা হয় কারণ এখানে আছে সব মিলিয়ে ১০০টির মত দুর্গ এবং ১৪০টির মত ব্যাংক।
লুক্সেমবার্গকে ইউরোপের অর্থনৈতিক রাজধানী বললেও ভুল হবে না। এর মোট আয়তন ২,৫৮৬.৪ বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা ২০১৮ সালের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী ৬ লাখের কিছু বেশি। সাধারণত লুক্সেমবার্গে অভিবাসীর সংখ্যা বেশি কারণ এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ থাকতে আসে।
লুক্সেমবার্গ দেশের পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী মোট বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১,০৮,৯৫১ ডলার। এটি বিশ্বের তৃতীয় ধনী দেশ।
সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুর একটি দ্বীপ রাষ্ট্র যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। আমরা সবাই সিঙ্গাপুর সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই জানি কারণ আমাদের পরিচিত অনেক মানুষ আছে যারা সিঙ্গাপুর কাজের জন্য বা ঘুরতে ভ্রমণ করে।
সিঙ্গাপুর একটি নগর রাষ্ট্র যার মোট আয়তন ৭১৯.৯ বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা ৫৬,০৭,৩০০ জন। অবস্থানের দিক দিয়ে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত।
সিঙ্গাপুর বর্তমান বিশ্বের চতুর্থ ধনী দেশ। এ দেশের বর্তমান পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১,০৩,১৮১ ডলার।
আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ড একটি দ্বীপ রাষ্ট্র যার মোট আয়তন ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। আয়ারল্যান্ড ব্রিটিশদের থেকে ১৯২১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে এবং এর রাজধানী হলো ডাবলিন। এই দেশের মোট জনসংখ্যা ২০০৬ সাল অনুযায়ী আনুমানিক ৪,২৩৯,৮৪৮ জন।
আয়ারল্যান্ড ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় অবস্থিত। আয়ারল্যান্ডের পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী মোট বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৮৩,৩৯৯ ডলার। একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এই অর্জন সত্যি অবিশ্বাস্য কিন্তু আয়ারল্যান্ড তা সত্য করে দেখিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ আয় আয়ারল্যান্ডকে বিশ্বের পঞ্চম ধনী দেশ হিসেবে স্বীকৃত করেছে।
ব্রুনেই দারুস সালাম
ব্রুনেই দারুস সালাম একটি ইসলামিক দেশ যেখানে ইসলামিক রাজতন্ত্র প্রচলিত আছে। ব্রুনাই মানচিত্রের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত যার উত্তরে চীন সাগর এবং বাকি দিক গুলোয় মালয়েশিয়া রাষ্ট্র অবস্থিত।
ব্রুনাই এর দুইটি সুমুদ্র বন্দর আছে যা তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া তাদের প্রধান আয়ের উৎস হলো তেল। অর্থাৎ ব্রুনাই তার তেলের খনির কারনে বিশ্বে ধনী দেশ গুলোর তালিকায় নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছে।
তাদের পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৮০,৩৮৪ ডলার। ব্রুনাইের আয়তন মাত্র ৫,৭৬৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২০১৫ সাল অনুযায়ী আনুমানিক মাত্র ৪১৭,২০০ জন। ব্রুনাই ব্রিটিশদের থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
নরওয়ে
নরওয়ে একটি ইউরোপীয় দেশ যা জনসংখ্যা ঘনত্ব অনেক কম। এর মোট আয়তন ৩,৮৫,২৫২ বর্গ কিলোমিটার এবং ২০২১ সাল অনুযায়ী আনুমানিক ৫,৩৯১,৩৬৯ জন। নরওয়ে একটি সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক দেশ যার বর্তমান রাজা হ্যারল্ড ৫।
যাহোক নরওয়েতে অনেক তেল এবং গ্যাসের খনি আছে যার ফলে তারা অনেক পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এছাড়া এর ভৌগোলিক অবস্থান অনেক শক্ত কারণ এর চারপাশের দেশ হলো রাশিয়া, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড। নরওয়ের পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৭৬,৬৮৪ ডলার যা তাদের বিশ্বের সপ্তম ধনী দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম শুনলেই চোখের সামনে এক অন্যরকম ধনী এবং বিলাসবহুল দেশের ছবি ভেসে ওঠে। যাইহোক সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যের আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত।
সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সংযুক্ত আরব আমীরশাহী বলা হয় কারণ সংযুক্ত আরব আমিরাত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্র দ্বারা তৈরি। এটি একটি সংযুক্ত রাষ্ট্র যার সবথেকে বড় শহর হলো দুবাই। এই দেশ মরুভূমির উপর অবস্থিত হওয়ার কারনে এখানে তেলের অসীম ভাণ্ডার পাওয়া যায় এবং বিশ্বের অনেক দেশ থেকে এখানে ইনভেস্ট করা হয় যার ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাত অনেক ধনী এবং বিলাসবহুল রাষ্ট্রে পরিনত হয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোট আয়তন ৮৩,৬০০ বর্গ কিলোমিটার এবং ২০১৭ সাল অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৯,৪০০,০০০ জন। এর বর্তমান পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৬৯,৪৩৫ ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের অষ্টম ধনী রাষ্ট্র।
কুয়েত
কুয়েত একটি সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যা ১৯৬১ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কুয়েত সৌদি আরব এবং ইরাক বেষ্টিত একটি আধুনিক এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্র। এর মোট আয়তন মাত্র ১৭,৮১৮ বর্গকিলোমিটার এবং ২০০৬ সাল অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৩,১০০,০০০ জন।
কুয়েতের প্রধান সম্পদ এর পেট্রোলিয়াম খনি। পুরো পৃথিবীতে কুয়েতি দিনারের মূল্য সব থেকে বেশি। কুয়েত বিশ্বের নবম ধনী রাষ্ট্র তাদের পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৬৬,৩৮৭ ডলার।
সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ড একটি ইউরোপীয় দেশ তবে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়। অবস্থানগত দিক দিয়ে সুইজারল্যান্ডের গুরুত্ব অনেক এবং দেখার মত অনেক কিছুই আছে এই দেশে। সুইস ব্যাংকের জন্য সুইজারল্যান্ড পুরো বিশ্বে অনেক পপুলার কারণ অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখার জন্য এই ব্যাংকের অনেক সুনাম আছে।
যাহোক সুইজারল্যান্ডের মোট আয়তন ৪১,২৮৫ বর্গ কিলোমিটার এবং ২০১৯ সাল অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৮,৫৭০,১৪৬ জন। সুইজারল্যান্ড বিশ্বের দশম ধনী দেশ যার পিপিপি জিডিপি অনুযায়ী বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৬৬,১৯৬ ডলার।
বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি অনেক পরিবর্তিত হলেও অনেক দেশ ধনী হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। আজকের লেখায় আমরা বর্তমান বিশ্বের ১০ টি ধনী দেশ এবং তাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় সম্পর্কে জানলাম। এখন আমরা জানবো বিশ্বের ১০ টি দরিদ্র দেশ সম্পর্কে। আশাকরি লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে। আপনার যে কোন মতামত আমাদের কমেন্ট বক্সে জানাবেন ধন্যবাদ।