গান এন্টারটেইনমেন্টের একটি অংশ যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মিউজিক পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। একেকজন একেক ধারার মিউজিক পছন্দ করে। গান আমাদের মনে আনন্দের সৃষ্টি করে এবং মনের দুঃখ দূর করে দেয়। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড় মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি যা থেকে মানুষ আত্মতৃপ্তির পাশাপাশি নিজের ক্যারিয়ার পরিচালনা করছে। এমন অনেক কণ্ঠশিল্পী আছে শুধু গান গেয়ে হাজার হাজার মানুষের মন জয় করেছে। আজ আমরা আপনাদের সামনে বাংলাদেশের সেরা ১০ জন গায়ক সম্পর্কে আলোচনা করবো। যারা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে তাদের সুর এবং কন্ট্রিবিউশন দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করেছে। কথা না বাড়িয়ে চলুন মূল আলোচনায় শুরু করা যাক।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে গায়কের অভাব নেই। তবে এসকল গায়কের মধ্যে এমন কিছু লিজেন্ডারী গায়ক আছেন যাদের পুরো দেশ এক নামে চেনে। চলুন তাদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়ে আসি।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোরের পুরো নাম এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। তিনি ১৯৫৫ সালে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী। দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এবং চলচিত্রে প্লেব্যাক কণ্ঠ দেওয়ার জন্য তাকে প্লেব্যাক সম্রাট উপাধি দেওয়া হয়।
তার অন্যান্য কন্ট্রিবিউশনের মধ্যে বেশ কিছু ফেমাস গান আছে যা আজো মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। তার “হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস”, “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে”, “আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি”, “আমার বুকের মধ্যে খানে”, “আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন” ইত্যাদি গান গুলো ইতিহাসের পাতায় এবং ভক্তদের মনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
তিনি চলচিত্রে প্লেব্যাক করার কারনে স্বীকৃতি হিসেবে মোট ৮ বার জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার এবং ৫ বার সেরা পুরুষ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এই গুনি শিল্পী ২০২০ সালে পরলোক গমন করেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
সাবিনা ইয়াসমিন ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অনেক গুণী একজন শিল্পী। তিনি প্রায় সব ধরনের গান গাওয়ায় পারদর্শী। তিনি অনেকগুলো দেশাত্মবোধক গান গেয়েছেন যা এখনো আমাদের মুখে মুখে আছে।
তিনি এপর্যন্ত কত গুলো গান গেয়েছেন তা নিজেই হিসেব করে বলতে পারবে না। শুধুমাত্র চলচিত্রে তিনি ১২ হাজারের মত গান গেয়েছেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে তিনি তার জীবনের প্রথম স্টেজ প্রোগ্রাম করেন। এছাড়া কিশোর কুমার ও মান্না দে এর মত লিজেন্ডারি সঙ্গীত শিল্পীর সাথে ডুয়েট করেছেন।
সাবিনা ইয়াসমিন এপর্যন্ত ১৪ বার জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। দেশে গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি বাইরের অনেক দেশে কনসার্ট করেছেন। গানের জগতে কন্ট্রিবিউশন এর জন্য ১৯৮৫ সালে ভারত সরকার তাকে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।
রুনা লায়লা
রুনা লায়লা একজন বহুমুখী কণ্ঠশিল্পী। তিনি বাংলাদেশের সিলেটে ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা একজন শিল্পী ছিলেন এবং তার মামার ভারতে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নাম ডাক ছিল। বাবার চাকরির সুবাদে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে তার শৈশব কাটে পাকিস্তানে।
এপর্যন্ত তিনি ১৮ টি ভাষায় ১০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। তিনি তার মিউজিকে কন্ট্রিবিউশনের জন্য দেশে এবং বিদেশে অনেক গুলো পুরস্কার এবং সন্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রি বাদেও তিনি ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের অনেক চলচিত্রে তার কণ্ঠ দিয়েছেন।
চলচিত্র বাদেও তিনি ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশ মিলে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে জাজ এবং গেস্ট হিসেবে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় গজল শিল্পী হিসেবে তার অনেক পপুলারিটি আছে। সাবিনা ইয়াসমিন এবং রুনা লায়লা আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক অনেক উন্নত করেছেন। তাদের এই উন্নয়নের ধারা এখন পর্যন্ত বজায় আছে।
আইয়ুব বাচ্চু
আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তিনি একজন রক ব্যান্ড শিল্পী ছিলেন কিন্তু তিনি কয়েকটি জনপ্রিয় একক অ্যালবাম তৈরি করেছিলেন। বন্ধুর গীটার দিয়ে গীটার বাজানো শেখা আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের সবথেকে প্রভাবশালী গীটার বাদক।
তার পুরো নাম আইয়ুব বাচ্চু রবিন। ক্যারিয়ারের শুরুতে “আগলি বয়েজ” নামক ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর নগর বাউল এবং সোলসে যোগদান করে তার সংগীত জীবন পরিচালনা করেন। তবে ১৯৯১ সালে তিনি তার নিজের ব্যান্ড “লিটল রিভার ব্যান্ড” যা পরবর্তীতে “লাভ রান্স ব্লাইন্ড” বা এলআরবি নামে পরিচিতি পায় তা প্রতিষ্ঠিত করেন।
একজন গীটারবাদক এবং সংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি অনেক সন্মাননা পেয়েছেন। এদের মধ্যে ছয়টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, একটি সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, বাচসাস পুরস্কার এবং টেলে সিনে আজীবন সম্মাননা উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালে দীর্ঘদিন ফুসফুসে পানি জমা রোগ নিনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রাম শহরে তার স্মৃতিতে রুপালী গীটার নামক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।
আসিফ আকবর
আসিফ আকবর ১৯৭২ সালে কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য পপ সংগীত শিল্পী। সম্প্রতি তিনি তার অভিনয় প্রতিভার প্রকাশ করেছেন ২০১৯ সালের গহীনের গান নামক চলচিত্রের মাধ্যমে।
তার সর্বপ্রথম অ্যালবাম ও “প্রিয়া তুমি কোথায়” যা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তিনি তার সংগীত জীবন শুরু করেন ১৯৯৮ সালে এবং এখন পর্যন্ত তার ৩০ টি একক অ্যালবাম রিলিজ হয়েছে।
তিনি সন্মাননা হিসেবে দুই বার জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, ছয়বার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার এবং সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস পেয়েছেন। একক অ্যালবাম বাদেও তিনি অন্যান্য শিল্পীর সাথে ডুয়েট গেয়েছেন। এছাড়া তিনি চলচিত্রে প্লেব্যাক হিসেবেও কাজ করেছেন।
হাবিব ওয়াহিদ
হাবিব তার বিশেষ ধারার মিউজিক পরিচালনার জন্য সবার কাছে পরিচিত। তিনি লোকগীতি গানের সাথে টেকনো এবং ওয়েস্টার্ন বিটের সমন্বয় করে যে গানের ধারার প্রবর্তন করে তা সারা দেশে ব্যাপক পপুলারিটি পায়।
হাবিব জনপ্রিয় পপ তারকা ফেরদৌস ওয়াহিদের সন্তান। মূলত তার বাবার থেকেই তার এই জগতে প্রবেশ করা। তার সর্বপ্রথম এবং সফল অ্যালবামের নাম “কৃষ্ণ” যা প্রথমে লন্ডনে রিলিজ হয় এবং একই নামে বাংলাদেশে রিলিজ হয়।
এরপর তিনি ১৩ টির মত অ্যালবাম রিলিজ করে এবং বেশ কয়কেটি সিঙ্গেল ট্র্যাক রিলিজ করে। দেশের তরুন সমাজের কাছে তার গান অনেক জনপ্রিয়।
বালাম
বালাম একজন বাংলাদেশী গায়ক, গীতিকার এবং সুরকার। তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম কাজী মোহাম্মদ আলী জাহাঙ্গীর বালাম। তিনি ক্যারিয়ারের শুরুতে নিজের ব্যান্ড রেনিগেডস প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে আর্ক, পেন্টাগন এবং ওয়ারফেজে দ্বিতীয় ও পরে প্রথম ভোকালিস্ট হিসেবে কাজ করেন।
২০০৭ সালে তিনি ওয়ারফেজ ছেড়ে দিয়ে বালাম নামে নিজের একক অ্যালবাম প্রকাশ করেন। যা মুহূর্তেই অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একই ধারাবাহিকতায় তিনি বালাম ২, বালাম ৩ নামক অ্যালবাম রিলিজ করেন।
বিশেষ করে নান্সি এবং তার আপন বন জুলির সাথে করা গান গুলো অনেক বেশি পপুলার হয়। সংগীত ইন্ডাস্ট্রি সন্মাননা হিসেবে তিনি অনেক গুলো পুরস্কার অর্জন করেন।
জেমস
জেমস এর পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম। তিনি রাজশাহীর নওগাঁ জেলায় ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। জেমসকে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে অবদানের জন্য গুরু বলে ডাকা হয়। তিনি একাধারে সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, গিটারিস্ট এবং বলিউড প্লেব্যাক কণ্ঠশিল্পী।
তিনি নগর বাউল (পূর্বে ছিল ফিলিংস) নামক ফেমাস রক ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি অনেকগুলো একক অ্যালবাম নিয়ে কাজ করেছেন এবং একক অ্যালবামে তার আগ্রহ সবসময় বেশি ছিল। জেমসকে বাংলাদেশে সাইকেডেলিক রক এর প্রবর্তক বলা হয় কারণ তার ব্যান্ড ফিলিংস এই ধারার রক সংগীত নিয়ে কাজ করে।
তিনি গীটার বাদেও আরও ৬ টি বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী। তিনি জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার বাদেও মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার এবং সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেন। বাংলাদেশে রক মিউজিক বিকাশে তার ভূমিকা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
তাহসান রহমান খান
তিনি একাধারে শিক্ষক, লেখক, সংগীত শিল্পী, মডেল, উপস্থাপক, গিটারিস্ট এবং অভিনেতা। মিডিয়া জগতে তাকে সবাই তাহসান নামেই চেনে। ১৯৭৯ সালে তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
তাহসান সাধারণত স্লো পপ সং গেয়ে থাকেন যা রোমান্টিক সং হিসেবে পুরো দেশে অনেক পপুলার। তিনি এবং তার কিছু বন্ধু মিলে তারা ১৯৯৮ সালে ব্ল্যাক নামক একটি ব্যান্ড টিম তৈরি করেন। পরে অবশ্য তিনি ব্ল্যাক ছেড়ে দিয়ে একক অ্যালবামের দিকে মুভ করেন এবং আশানুরূপ সারা পায়।
গান করা বাদেও তিনি অনেক ভালো অভিনয় করে এবং বাংলাদেশে তার নাটক অনেক পপুলার। সম্প্রতি তিনি মুভি এবং ওয়েব সিরিজে অভিনয় করা শুরু করে দিয়েছেন।
অর্ণব
অর্ণবের পুরো নাম শায়ান চৌধুরী অর্ণব। তিনি ১৯৭৮ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ক্যারিয়ার শুরুর দিকে তিনি বাংলা নামক একটি পপুলার ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। পরে নিজের একটি ব্যান্ড তৈরি করেন এবং একক অ্যালবাম রিলিজ করার দিকে মনোযোগ দেন।
অর্ণবের এপর্যন্ত ৬ টি অ্যালবাম রিলিজ হয়েছে। তিনি একজন পপুলার সংগীত প্রযোজক, সংগীত লেখক, গায়ক এবং গিটারিস্ট। অর্ণব গীটার বাদেও আরও চারটি ভিন্ন ভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী।
তিনি রক, ফিউশন, লোকগীতি এবং রবীন্দ্রসংগীত বিভাগে গান করেন। তিনি আয়নাবাজি এবং মনপুরার মত লিজেন্ডারি বাংলা চলচিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন।
বাংলাদেশে অনেক গুণী সংগীত প্রেমী যুগে যুগে এসেছে। আমরা সে সকল গায়কের গান শুনে নিজের মনের দুঃখ ভুলে থাকার পাশাপাশি আনন্দ পেয়েছি। পুরো লেখায় বাংলাদেশের সেরা ১০ জন গায়ককে কভার করা হয়েছে। আশাকরি লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে। এই লেখা নিয়ে আপনার কোন মতামত থাকলে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন ধন্যবাদ।