সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমন কিছু রোগে আক্রান্ত হচ্ছি যার পেছনে অতিরিক্ত ওজন অনেকাংশে দ্বায়ী। অতিরিক্ত ওজন শরীরে বাড়তি চর্বি যোগ করে যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। একই সাথে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে। এই বাড়তি ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যায়াম এবং প্রোপার ডায়েট অতি জরুরী। কিন্তু রমজান মাসে স্বাভাবিক ডায়েট মেইন্টেইন করা অনেক কঠিন হয়ে পরে। কারণ সারাদিন রোজা রেখে শরীর এমনিতে অনেক ক্লান্ত থাকে। এছাড়া রোজার সময় সারাদিন না খেয়ে থেকে আমরা সেহেরী এবং ইফতারে অতিরিক্ত খেয়ে থাকি। এতে আমরা রোজার সময়ে না খেয়ে থেকে যে টুকু কম খাই তার থেকে বেশি বাকি সময়ে খেয়ে ফেলি। আমাদের আজকের পোস্টে রোজার মাসে ওজন কমানোর উপায় সম্পর্কে জানবো।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
রোজার মাসে ওজন কমানোর উপায় সমূহ
রোজার মাসে আমরা সাধারণত তিন সময় খাই যা স্বাভাবিক সময়ের থেকে একটু ভিন্ন। যেমন রোজার মাস বাদে আমরা সকাল, দুপুর এবং রাতে খাওয়া করি। কিন্তু রোজার মাসে আমরা ফজরে সেহেরী, সন্ধ্যায় ইফতার এবং রাতে রাতের খাবার খাই। সাধারণত রোজার মাসে আমাদের ওজন কমানোর পর্যাপ্ত সময় এবং সুযোগ থাকলেও ওজন না কমে বেড়ে যায়।
এর পেছনে কারণ হলো এমনি সময় আমরা যেটুকু খাই তা শুধু খিদে পাওয়ার কারনে। কিন্তু রোজার সময় আমাদের চিন্তা থাকে যে সারাদিন না খেয়ে থাকার জন্য যেটুকু ক্যালরি দরকার তা যেন আমাদের দেহে সংরক্ষিত থাকে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সেহেরী এবং ইফতারের সময় প্রয়োজনের থেকেও বেশি খেয়ে ফেলি।
এই অতিরিক্ত খাওয়ার জন্য আমাদের শরীরে অতিরিক্ত ক্যালরি জমা হয় এবং তা ধিরে ধিরে শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়। এখন এই সমস্যা থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করা যাবে তা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
সঠিক ডায়েট প্ল্যান
কোন প্রকার ঔষধ বা ট্রিটমেন্ট ছাড়াও যে বাড়তি ওজন কমানো যায় রমজান মাস তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তবে এর জন্য সঠিক ডায়েট প্ল্যান প্রয়োজন। সহজ করে বলতে গেলে সেহেরী, ইফতার এবং রাতের খাবার প্ল্যান মোতাবেক খেতে হবে।
সেহেরী টাইম: সেহেরীর খাবার আইটেম ওজন কমানোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ডায়েট। সারাদিন আপনার শরীরে শক্তি যোগান দেওয়ার জন্য কি কি আইটেম সেহেরিতে থাকতে হবে তা নির্ধারণ করে নিতে হবে। যেমন অতিরিক্ত তেল, মশলা এবং লবণ যুক্ত খাবার শরীরের পানি স্বল্পতা তৈরি করে। এতে সারাদিন প্রচুর পানি পিপাসা পেতে থাকে। পানির অভাবে শরীরের প্রতিটি কোষ তার সাধারণ কার্যক্ষমতা হারায়।
এছাড়া এতে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয় যা শরীরে বাড়তি ওজন যোগ করে। তাই সেহেরিতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অতি জরুরী। যেমন শাকসবজি, ফল, সালাদ, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি পরিমাণ মত খেতে হবে।
যা খাওয়া যাবে না
- অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার
- লবণ যুক্ত খাবার
- মশলা যুক্ত খাবার
- না খেয়ে থাকা
- ভাঁজা পোড়া খাবার
যা খাওয়া যাবে
- দুধ
- ফল
- শাকসবজি
- টক দই
- ১ পিস মাছ/১ বা ২ পিস মুরগির মাংস
- কুসুম ছাড়া ডিম
- ১টি রুটি/ এক কাপ ভাত
- সিদ্ধ সবজি
- বেশি বেশি পানি
- কম মশলা যুক্ত খাবার
ইফতার টাইম
সারাদিন না খেয়ে থেকে আমরা ইফতারের সময় একবারে সারাদিনের খাবার খেয়ে ফেলি। এতে শরীরের উপকারের থেকে অপকার বেশি হয়। সাধারণত শরীর কাজ করে ক্যালরির উপর নির্ভর করে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালরি সাপ্লাই করা হয়ে শরীর তা থেকেই শক্তি সঞ্চয় করে।
কিন্তু যদি অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালরি শরীরে দেওয়া হয় তাহলে তা এই অতিরিক্ত পরিমাণ ক্যালরি শরীরে জমা করে রাখে। পরে এই ক্যালরি শরীরে চর্বি আকারে জমা হয় যা শরীরে বাড়তি ওজন যোগ করা বাদেও অন্যান্য সমস্যা তৈরি করে। ইফতারে কোন কোন খাবার খেলে ওজন কমানো যাবে তা নিচে লিস্ট আকারে দেওয়া হলো।
যা খাওয়া যাবে না
- তেলে ভাঁজা খাবার
- অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার
- কৃত্তিম রংযুক্ত পানীয়
- বেশি মশলা যুক্ত খাবার
- অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার
যা খাওয়া যাবে
- লেবুর শরবত
- ১টি পেঁয়াজু, ১টি বেগুনী, ১টি সিঙ্গারা
- ডাবের পানি
- ছোলা বুট + মুড়ি (১ বাটি)
- ১ বাটি হালিম (বুট মুড়ি না খেলে)
- একটু সালাদ
- ৪/৫ টি খেজুর
- ১টি কলা/ ১টি আপেল
- দই
- নান রুটি
ডিনার টাইম
সচরাচর রোজার মাসে অনেকেই রাতের খাবার গ্রহণ করে আবার অনেকেই আছে যারা খায় না। তবে রাতের খাবার স্কিপ করা উচিত না কারণ এতে শরীরের পুষ্টির মাত্রা ঠিক থাকে এবং শরীর পরিমিত ক্যালরি পায়। যাহোক, ইফতারে পরিমাণ মত খেলে রাতের খাবার অবশ্যই প্রয়োজন পরবে।
রাতের খাবারের জন্য হালকা পাতলা খাবার বেশি উপযুক্ত। এমনিতেও রাতে খুব স্বল্প পরিমাণ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে রমজান মাসে ওজন কমানোর জন্য ডিনার যাতে পারফেক্ট হয় সে ব্যাপারে আমাদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে। রাতের খাবারে কোন কোন আইটেম রাখা যাবে তার একটু ধারনা নিচে দেওয়া হলো।
যা খাওয়া যাবে না
- ফাস্ট ফুড
- তেল জাতীয় খাবার
- তেলে ভাঁজা খাবার
- অতিরিক্ত পরিমাণ খাবার
- অতিরিক্ত লবণ এবং মশলা যুক্ত খাবার
- বেশি পরিমাণ ভাত
যা খাওয়া যাবে
- দুধ
- ১টি রুটি
- অল্প পরিমাণ ভাত
- ১ পিস মাছ/মাংস
- ১টি ডিম
- লাচ্ছি/পনির
- টক দই
- শাকসবজি
রমজানের ডায়েট সম্পর্কিত টিপস
- বেশি বেশি পানি পান করতে হবে। কারণ পানি যেমন শরীরের প্রতিটি কোষ জীবন্ত রাখে তেমনি শরীর সতেজ থাকে। কোন কারনে শরীর অতিরিক্ত ঘেমে গেলেও ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
- শরীরের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালরি যোগান দেওয়ার মত খাবার গ্রহণ করতে হবে। ক্যালরি ষ্টোর করে তা পরবর্তী সময়ে ইউজ করার চিন্তাভাবনা থেকে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা যাবে না।
- ফাস্ট ফুড থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ প্রতিটি ফাস্ট ফুড অনেক হাই ক্যালরির হয়। এছাড়া এগুলো পাকস্থলীর অনেক বেশি ক্ষতি করে। তবে পরিমিত মাত্রায় ফাস্ট ফুড গ্রহণ করা যাবে যেমন ১ স্লাইস পিজ্জা, ১ টুকরো ফ্রাইড চিকেন, ১ প্যাকেট ছোট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি।
- গ্রীন টি শরীরের জন্য অনেক উপকারী। গ্রীন টি না পান করার ইচ্ছা হলে দুধ এবং চিনি ছাড়া রং চা গ্রহণ করতে পারেন।
- একবারে অনেক খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে খাবার গ্রহণ করুন। এতে পাকস্থলীর উপর অতিরিক্ত চাপ পরে না এবং শরীর দ্রুত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে।
- সেহেরী অথবা ইফতারের পর ১৫ – ২০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস শরীরের জন্য অনেক উপকারী। এতে খাবার ভালোভাবে হজম হয় এবং শরীরের ব্যায়াম হয়ে যায়। যেহেতু রমজান মাসে সাধারনভাবে ব্যায়াম করার সময় বা সুযোগ থাকে না সে ক্ষেত্রে একটু হাঁটাহাঁটি অনেক উপকার করে। অন্যদিকে এতে শরীরে এক্সট্রা ওজন অ্যাড হওয়ার সুযোগ থাকে না।
রমজান মাস ওজন কমানোর জন্য একটি আদর্শ সময়। রমজান মাসে সারাদিন রোজা দেওয়ার কারনে শরীরে যে এক্সট্রা চর্বি জমা থাকে তা বার্ন হয়ে শরীরের শক্তি যোগান দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ওজন কমানোর জন্য রোজা অন্যান্য ডায়েট প্ল্যানের থেকে অনেক বেশি কার্যকরী। তবে অবশ্যই তা প্ল্যান মোতাবেক এবং পুষ্টি বিজ্ঞানের সমর্থিত হতে হবে। আশাকরি এই পোস্ট পরে রোজার সময়ে কীভাবে ওজন কমানো যায় সে বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। আরও কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাবেন ধন্যবাদ।