একটি নতুন পরিবার শুরু করা এবং একটি নতুন জীবন আনায়ন সত্যিই যেন আনন্দের অনুভূতি। প্রতিনিয়ত আপনি আপনার চার পাশে শত শত নিত্য নতুন জিনিসের অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। তাছাড়ও আপনার কাছে অগ্রাধিকার পবে আপনার অনাগত সন্তানের সুস্থতা বজায় রাখা। গর্ভাবস্থায় এই নয় মাস প্রত্যেক নারীর জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও গর্ভাবস্থা আপনি কি ধরনের খাবার খাবেন সেসব সম্পর্কে আপনার আত্মীয়স্বজন, আপনজনদের থেকে অনেক পরামর্শ পাবেন। অনেক মহিলারা গর্ভাবস্থায় কাঁচা আম খেতে দিধাগ্রস্ত হন। কারন তারা ভাবে যে গর্ভাবস্থায় আম খেলে তার অনাগত সন্তানের ক্ষতি হতে পারে এবং এসব ভেবে তারা আম খেতে চান না। গর্ভাবস্থায় কাঁচা পাকা যেকোন আমই খাওয়া যায়।
ফলের রাজা বলা হয় আমকে। আম খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। এই ফল খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টি গুণে ভরপুর। আমে রয়েছে ভিটামিন এ, বি৬ ও সি এবং প্রচুর ক্যালোরি যা গর্ভাবস্থায় খাওয়ার ফলে গর্ভবতী মহিলার শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গুণের চাহিদা পূরণ করে। অনেকে বলে থাকে গর্ভাবস্থায় আম খেলে শরীরের তাপ বৃদ্ধি পায়। এধারনা সম্পূর্ন ভুল। মূলত আদা, মরিচ, মসলা এই ধরনের খাবার গুলো হজম প্রক্রিয়া করার অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয় এবং এগুলো শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য দায়ী। তবে প্রমাণ নেই যে, আম খেলে শরীরের তাপ বৃদ্ধি হয় বা অনাগত সন্তানের ক্ষতি হয়।
আমে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও শক্তির উৎস। যা গর্ভাবস্থায় সময় অপরিহার্য। বাজার থেকে আম ক্রয় করার সময় বাজারে ফরমলিন দিয়ে পাকানো আম কেনা থেকে অবশ্যই শতর্ক থাকতে হবে এবং প্রাকৃতিকভাবে পাকা আম ক্রয় করতে হবে। কারণ ফরমালিন দেয়া যেকোন ফল শরীরের উপকারের থেকে ক্ষদি বেশি করে। তাই দামে একটু বেশি হলেও ফরমালিনমুক্ত ফল নিতে হবে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
আমের পুষ্টির মান
আমে প্রচুর পরিমানে পুষ্টি রয়েছে, যা শরীরের জন্য অত্যান্ত্য উপকারি। আম হচ্ছে ভিটামিন এ এর একটি উৎস, আমে প্রচুর প্রি-বায়োটিক ফাইবার বিদ্যমান রয়েছে এবং বিটা ক্যারোটিন, আলফা, বিটা-ক্রিপটোক্স্যান্টিনের এর মতো উপাদান দিয়ে পূর্ণ। নিম্নে প্রতি ১০০ গ্রাম আমের পুষ্টি উপাদানগুলোর তালিকা দেয়া হলো:
- পটাশিয়াম – ১৫৬ মিলিগ্রাম
- কপার – ০.১১০ মিলিগ্রাম
- প্রোটিন – ০.৫ গ্রাম
- ক্যালশিয়াম – ১০ গ্রাম
- শক্তি – ৭০ ক্যালোরি
- আয়রন – ০.১৩ মিলিগ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ – ০.০২৭ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম – ২ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন এ – ৭৬৫।U
- ভিটামিন সি – ২৭.৭ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন ই – ১.১২ মিলিগ্রাম
- ডায়েটরি ফাইবার – ১.৮০ গ্রাম
- মোট ফ্যাট – ০.২৭ গ্রাম
- ম্যাগনেশিয়াম – ৯ মিলিগ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট – ১৭ গ্রাম
আম হচ্ছে ক্যালোরি সমৃদ্ধ ফল। গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আম খাওয়া উচিত। আবার ডায়েটেও খাবারের তালিকায় আম রাখতে পারেন। আশা করি এতে ভালো ফল পাবেন। অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না। তেমনি আপনি যদি অতিরিক্ত পরিমানে আম খান তাহলে শরীরে ক্যালোরির পরিমান বেড়ে যাবে এবং আপনার অনাগত শিশুর ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রতিদিন ১/২টি আম খেতে পারেন। এর বেশি খাওয়া উচিত নয়।
গর্ভাবস্থায় আম খাওয়ার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারিতা
আম টক ও মিষ্টি স্বাদের হওয়ার কারণে গর্ভাবস্থায় মহিলাদের কাছে এই ফল খুবই প্রিয় একটি ফল। কারণ এই ফল খেলে বমি বমি ভাবের অনূভুতি হ্রাস পায়। এই ফলের পুষ্টি গুণের উপর ভিত্তি করে আম খাওয়ার উপকারিতা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
- আমে প্রচুর পরিমাণে ফলিক এসিড রয়েছে যা গর্ভাবস্থায় ভ্রুনের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। এই ফলে ফলিক এসিড থাকায় গর্ভাবস্থায় প্রথম ত্রৈমাসিক শিশুর মস্তিষ্কের এবং স্নায়ুন্ত্রের বিকাশ হতে সহায়তা করে।
- আমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ রয়েছে যা স্নায়ুন্ত্রক ও চোখকে সমৃদ্ধ করার সময় শিশুর হাড়ও দাঁত উন্নয়নে সাহায্য করে। ইতিমধ্যেই আপনি যদি ভিটামিন এ গ্রহণ করে থাকেন তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কারণ অতিরিক্ত ভিটামিন এ এর মাত্রা শিশুর ভিতরে লিভার বিষাক্ততার কারণ হতে পারে।
- গর্ভাবস্থায় মহিলাদের অ্যামিনিয়া প্রতিরোধের জন্য লৌহর সম্পূরক গুলো খাওয়া উচিত। প্রতিদিন যদি ১/২ টা আম খেতে পারেন তাহলে এই ফল লৌহ সরবরাহ করে। যা অ্যামিনিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য রক্তে কোষ বৃদ্ধি করে।
- আমে উচ্চ স্তরে ডায়েরটরি ফাইবার রয়েছে যা পাচক সিস্টেমকে শক্তিশালী অবস্থায় রাখার জন্য দরকার। কোষ্ঠকাঠিণ্য এড়াতেও আম সহায়তা করে।
- ভিটামিন বি৬ বিদ্যমান থাকায় ফলিক এসিডের মতো স্নায়ুতন্ত্রের ও ভ্রুণের বিকাশ ঘটাতে কাজ করে।
- আমে যে ভিটামিন সি রয়েছে সেগুলো একটি শক্তিশালী অ্যানিটঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। যা মানব দেহের ক্রমবর্ধমান রেডিকেলগুলোকে প্রতিরোধ করে থাকে। তাছাড়া তামাক, সিগারেট, মদ্যপান ইত্যাদি এই সমস্ত বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ এগুলো নবজাতকের বেড়ে উঠতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং অনাগত সন্তানের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই এসব এড়িয়ে চলা উত্তম।
- ম্যাগনেশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ এর জন্য প্রাকৃতিক নিরাময় এবং পিক্ল্যাম্পসিয়া নামক হাইপারেটেনসিভ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
৬ মাসের গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভাবস্থায় পাকা আম খাওয়ার উপকারিতা
কাচা আম খাওয়ার পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় পাকা খাওয়ারও বিশেষ কিছু উপকারিতা আছে। আমার এখন গর্ভাবস্থায় পাকা আম খাওয়ার উপকারিতাগুলো সম্পর্কে জানবো:
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা
আমে প্রচুর ভিটামিন এ, বি৬, সি রয়েছে। গর্ভাবস্থায় আম খাওয়া যাবে না কিংবা খেলে বিভিন্ন ধরনের রোগ হবে বা রোগ প্রতিরোধ কমে যাবে এমন ধারণা ভুল। তাই গর্ভবতী মহিলা কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই আম খেতে পারেন। তবে অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। এই ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সন্তানের চোখের জন্য ভিটামিন এ খুবই উপকারি। আম টক ও মিষ্টি স্বাধের হওয়ায় প্রায় সবাই খেতেও পছন্দ করেন। এছাড়া মিনারেল ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন বি সন্তানের মস্তিষ্ক, রক্তচাপ এবং গর্ভবতী মায়ের জন্য অনেক উপকারি। যা আমে প্রাকৃতিক ভাবেই আছে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য আশঁ। অনেক গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন সময় কোষ্টকঠিন্য রোগ দেখা দেয়। পাকা আমে আশঁ বা ফাইবার থাকায় গর্ভবতী মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের সমস্যা দূর করতে দারুন কাজ করে।
আয়রনের অভাব পূরণ করে ও দূর করে
গর্ভাবস্থায় অনেক গর্ভবতী নারীর আয়রনের অভাব দেখা দেয়। এ সময় মায়ের ও তার শরীরে বেড়ে ওঠা শিশুর পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রয়োজন। যার কারণে গর্ভবতী মায়ের শরীরে রক্ত অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দেয়। তাই গর্ভবতী মাকে প্রয়োজন অনুযায়ী পাকা আম খেতে দিন। পাকা আম গর্ভবতী নারীর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে অর্থাৎ রক্তের মাত্রা বৃদ্ধি করতে বেশ কাজ করে।
স্বল্প ওজন ও অকাল জন্ম রোধ করে
যেসব মহিলারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফোলেট পান করেন না সেসব মহিলাদের স্নায়ু বিফিডার মতো নিউরাল টিউব ক্রটিযুক্ত সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বা ঝুঁকি থাকে। ফোলেটের ঘাটতি হলে অকাল অথবা স্বল্প ওজনের সন্তান হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং স্বল্প ওজনের বাচ্চা হলে অনেক সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয়।
প্রতিটি আমে ৫০% ফোলেট আছে। এছাড়াও ৩/৫ কাপ আমে ভিটামিন এ ৫%, ভিটামিন সি ৫০%, ফাইবার ৭% এবং ভিটামিন বি৬ রয়েছে ৪%। যার কারণে আম খুবই উপকারি একটি ফল ও পুষ্টি গুণে ভরপুর।
কৃত্রিম উপায়ে পাকানো আম খেলে যেসব সমস্যা হয়
আম ব্যবসায়ীরা তাড়াতাড়ি আম পাকানোর জন্য বিভিন্ন ক্যামিক্যাল ব্যবহার করে থাকে। রাসায়নিক ভাবে পাকানো আম খেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ক্যামিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রোগের সৃষ্টি হয়। যেমন-
- শ্বাসকষ্ট
- জন্ডিস
- বদহজম
- ক্যান্সার
- অ্যাজমা
- পেটেরপীড়া
- গ্যাসট্রিক
- পাতলা-পায়খানা
- লিভার জন্ডিস
- কিডনি সহ জটিল রোগের সৃষ্টি করে।
তাছাড়া এর প্রভাবে গর্ভবতী মহিলারা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। বিষাক্ত পদার্থের ফলে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
পরিশেষে এটাই বলবো আম খুব সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি একটি ফল। তবে অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না হোক সেটা আম বা অন্য কোন খাবার। অনেকে আবার গর্ভাবস্থায় ডায়বেটিকস রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। গর্ভাবস্থায় আম ও ফলমুল খাওয়া নিরাপদ। তাই সব সময় খাবার খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। গর্ভাবস্থায় কি খাওয়া উচিৎ আর কি নিষেধ অবশ্যই সেগুলো সম্পর্কে জনার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া উচিত।