কিডনি আমাদের শরীরের এমন একটি অংশ যার মাধ্যমে বিপাক ক্রিয়ায় তৈরী সব বর্জ্য শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তাই কিডনি শরীরের একটি অপরিহার্য অংশ। আর কিডনি সমস্যা হওয়ায় মানে আপনার শরীরের বর্জ্য পদার্থ গুলো সঠিকভাবে অপসারণে ব্যর্থ হওয়া। আর এই বর্জ্য যখন শরীরে থেকে যায় এগুলা রক্তে জমা হয়ে যায়। এই সময়ে কিডনি অস্থায়ী কিংবা স্থায়ীভাবে ড্যামেজ এর স্বীকার হয়। এমতাবস্থায় রোগীর বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই কিডনির সমস্যা কোন ভাবেই অবহেলা করা চলবে না।
দূর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কিডনির সমস্যা বাড়ছে। কিডনি অস্থায়ী ড্যামেজ কিংবা স্থায়ীভাবে বিকল হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব সাধারণ মানুষের মধ্যে কিডনির সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী করতে হবে৷ আমরা আপনাদের কাছে তুলে ধরব কিডনি সমস্যার খুঁটিনাটি। কিডনি সমস্যার কারণ, চিকিৎসা ও আপনি কিভাবে বুঝবেন আপনার কিডনির সমস্যা আছে কিনা, এসব বিস্তারিত বলব।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
কিডনি সমস্যার প্রকারভেদ
কিডনির সমস্যার ধরন দুটি।
- কিডনি অস্থায়ী ড্যামেজ হওয়া
- স্থায়ীভাবে কিডনি বিকল হওয়া।
বিভিন্ন কারনে কিডনির এই সমস্যা দুটি সৃষ্টি হতে পারে।
কিডনি অস্থায়ী ড্যামেজ
হঠাৎ করে কোনো কারনে যদি কিডনিতে রক্ত প্রবাহ কমে যায় তখন কিডনি অস্থায়ী ভাবে ড্যামেজ হতে পারে। ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির অভাবে এবং পানিবাহিত রোগবালাই এর জন্য কিডনিতে রক্ত প্রবাহ কমে যেতে পারে। অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ও দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ঔষধ সেবনের কারনেও কিডনি অস্থায়ী ভাবে ড্যামেজ হতে পারে। তবে এই সমস্যা গুলো নিরাময় করা সম্ভব।
স্থায়ীভাবে কিডনি ড্যামেজ
আরেক ধরনের কিডনি সমস্যা রয়েছে যার কারনে কিডনি স্থায়ীভাবে বিকল হতে পারে। একে বলা হয় ক্রনিক কিডনি ডিজিজ। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে এই সমস্যা তৈরী হয়৷ বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে কিডনি বিকল হবার সমস্যাটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিডনি বিকল হলে কি ঘটে
কিডনি আমাদের শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থ গুলো অপসারণ করে। তাই কিডনি অকেজো হয়ে গেলে শরীরের এই অপ্রয়োজনীয় পদার্থ গুলো বের হতে পারে না এবং রক্তে গিয়ে জমাট বাধে। এর ফলে শরীরে থাকা ক্যালসিয়াম,সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি পদার্থের ভারসাম্য নষ্ট হয়। রক্তশূন্যতা দেখা যায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
কিডনি সমস্যার ১০ টি লক্ষণ
কিডনির সমস্যা হলে তার লক্ষণ শরীরে অনেক ভাবে দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো হলো:
প্রস্রাবের সময়ে যন্ত্রণা
কিডনি সমস্যার একটি প্রধান লক্ষণ হচ্ছে প্রস্রাবের সময়ে যন্ত্রণা হওয়া। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ফলে মূলত প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হয়। আর এই ইনফেকশনটিই কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ঘন ঘন জ্বর হয় আর পিঠে ব্যথা হয়।
প্রস্রাবের অভ্যাস পরিবর্তন
কিডনির সমস্যা হলে প্রস্রাবের অভ্যাসে পরিবর্তন আসে। কারো ক্ষেত্রে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। আবার কারো ক্ষেত্রে প্রস্রাবের মাত্রা কম হয়। মূলত রাতে এই সমস্যা বাড়ে। তখন প্রস্রাবের বেগ অনুভব হয় কিন্তু প্রস্রাব হয় না। আর হলেও গাড় রংয়ের হয়।
প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত হওয়া
প্রস্রাবের সাথে রক্তপাত হওয়া খুবই ভয়াবহ একটি বিষয়। এটি সাধারণ কিডনি ড্যামেজ নয়। স্থায়ী কিডনি বিকল অর্থাৎ ক্রনিক কিডনি ডিজিজ এর লক্ষণ।
চামড়ায় দাগ হওয়া
কিডনি যখন বিকল হয়ে যায় বা কার্যক্ষমতা হারায় তখন রক্তে বর্জ্য পদার্থ বাড়ে। এর ফলে ত্বকে চুলকানি হয় এবং চামড়ায় দাগ তৈরী করে।
বমি হওয়া
রক্তে যখন বর্জ্য পদার্থ বেড়ে যায় তখন বার বার বমি হয়। অনেক সময় শুধু বমি বমি ভাব হয়।
শ্বাস ছোট হয়ে আসা
কিডনি সমস্যা হলে ফুসফুসে অপ্রয়োজনীয় তরল পদার্থ জমা হয়। এছাড়া কিডনি বিকল হলে রক্তশূন্যতাও দেখা যায়। এজন্য রোগীর অনেক সময় শ্বাসকষ্ট অনুভব হয়। রোগী ছোট ছোট শ্বাস নেয়।
পিঠে ও শরীরের নিচের অংশে ব্যথা
কিডনির সমস্যায় অনেকের শরীর ব্যথা হয়। বেশিরভাগ সময়ে পিঠে ও শরীরের নীচের অংশে ব্যথা হয়।
শরীরে সবসময় শীত অনুভব হওয়া
এসময়ে রক্তশূন্যতা কিংবা অন্য কারনে শরীরে শীত বোধ হয়। গরম আবহাওয়া থাকলেও অনেকে শীত শীত অনুভব করে।
দেহের কোন অংশ ফুলে যাওয়া
কিডনি শরীরের অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য বের করে দেয়। কিন্তু কিডনি অকেজো হলে রক্তে পানি জমে। এবং শরীর ফুলে যায়।
কাজকর্মে মনোযোগ এর অভাব
এসময়ে রক্তে লোহিত রক্তকণিকা কমে যায় তাই মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিবহনও কমে যায়। ফলে কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির কাজকর্মে মনযোগ কমে যায়।
শিশুদের কিডনি সমস্যার লক্ষণ
শিশুদের কিডনি সমস্যার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে প্রস্রাবে ইনফেকশন। ইনফেকশনের ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় ও প্রস্রাবের সময় প্রচুর জ্বালাপোড়া অনুভূব হয়। অনেকের প্রস্রাবের রং অনেক গাড় হয় কিংবা লালচে হয়।
কিডনি সমস্যার চিকিৎসা
প্রথমত কিডনি সমস্যার চিকিৎসার জন্য এই রোগ শনাক্ত করতে হবে। মাত্র দুটি পরীক্ষা থেকে কিডনি সমস্যা আছে কিনা জানা যায়।
- প্রস্রাবের সাথে অ্যালবুমিন বা মাইক্রো অ্যালবুমিন যায় কিনা
- রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা
কিডনির সমস্যা শনাক্ত হবার পর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
অনেকের কিডনি সমস্যা তেমন জটিল হয় না অর্থাৎ স্থায়ী বিকল হয় না। তারা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করলে সুস্থ হতে পারবেন।
আর কিডনি যাদের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায় তাদের জন্য দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি
রয়েছে।
- ডায়ালাইসিস বা যন্ত্রের মাধ্যমে কিডনির কাজ সম্পাদন
- কিডনি প্রতিস্থাপন
কিডনি ভাল রাখার উপায়
কিডনি সাময়িক বিকল হয়ে যাওয়া কিংবা পুরোপুরি অকেজো হওয়ার আগেই এর যত্ন নেওয়া জরুরি। তাই জেনে নিন কিডনি ভাল রাখার উপায়
পর্যাপ্ত পানি পান
কিডনি ভাল রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করার কোনো বিকল্প নেই। আপনার শরীরে পরিমিত পানির উপস্থিতি শুধু কিডনি নয়, আপনার দেহের যাবতীয় অনেক সমস্যার সমাধান করবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। প্রতিদিন অবশ্যই ৭-৮ গ্লাস পানি পান করতে হবে।
জীবনধারণে পরিবর্তন
জীবনধারণে কিছু পরিবর্তন আনতে পারলে আপনার জন্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তাই কিডনির সমস্যা এড়াতে জীবনধারনে কিছু পরিবর্তন আনুন যেমন
- কখনই প্রস্রাব চেপে রাখবেন না
- সবসময় কম বেশি কায়িক পরিশ্রম করবেন
- অলস জীবনযাপন পরিহার করবেন
- পরিমিত পরিমাণে ঘুমানোর চেষ্টা করবেন।
সচেতনতা
যে কোন রোগ প্রতিরোধ করতে সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই। কারন শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ অকেজো হয়ে যাওয়া মানে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যাওয়া। তাই কিডনি ভালো রাখতে
- ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
- ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন
- চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে ব্যাথানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক ঔষুধ সেবন করবেন না।
- কিডনি রোগের অন্যতম লক্ষণ হল প্রস্রাবে আমিষ বা অ্যালবুমিন নির্গত হওয়া। তাই নিয়মিত মাইক্রো অ্যালবুমিন টেস্ট করুন।
একটি জরিপে দেখা যায় এদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ ছোট বড় যে কোন ধরনের কিডনি সমস্যায় ভুগে। আর যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে প্রতিবছর ৪০ হাজারের মত লোকের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন এ রোগের ভয়াবহতা কি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই অসচেতনভাবে কোনো রোগকে কঠিন অবস্থার দিকে নিয়ে যাবেন না।
কিডনি সমস্যার লক্ষণ দেখে সমস্যা শনাক্ত করতে পারলে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। কিভাবে বুঝবেন আপনার কিডনির সমস্যা আছে কিনা, কিভাবে এর চিকিৎসা করাবেন এবং কিভাবে কিডনি ভাল রাখবেন এ ব্যপারে সকল তথ্য আপনাদেরকে দেয়ার চেষ্টা করেছি। এবার আপনার সুস্বাস্থ্যের দায়িত্ব আপনার।