আমাদের শরীর যখন রক্তে থাকা গ্লুকোজকে ভাঙ্গতে পারে না তখনই ডায়াবেটিস হয়। বিভিন্ন কারনে মানুষ প্রতিনিয়ত ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হচ্ছে। বয়স, লিঙ্গ, জীবনধারণ সব কিছুর উপরে ভিত্তি করে নানা ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে যে রোগ মানুষকে বেশি ভোগাচ্ছে সেটি হচ্ছে ডায়াবেটিস৷ এটি এমনই একটি রোগ যা আপনার শরীরে হাজারটা রোগের উপসর্গ তৈরী করে দেয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এখন একটি সাধারণ রোগে পরিনত হয়েছে এই ডায়াবেটিস৷ তবে এর জটিলতা অনেক বেশি। ডায়াবেটিস এর কারনে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, কিডনী বিকল, গর্ভপাতের মত নানা সমস্যা তৈরী হতে পারে।
সারা বিশ্বে যখন ডায়াবেটিস এর প্রকোপ দ্রুত হারে বাড়ছে, এখন সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাই আমাদের প্রত্যেককে জানতে হবে ডায়াবেটিস কি,এর কারন, লক্ষণ এবং এর প্রতিকার। আমরা আজকে আপনাদের কাছে এই তথ্য গুলো তুলে ধরব।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
ডায়াবেটিস কি
আমাদের দেহে ইনসুলিন নামক একটি হরমোন থাকে। কারো শরীরে যখন এই হরমনের ঘাটতি থাকে তখন বিপাকজনিত জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং রক্তের গ্লুকোজের পরিমান বাড়িয়ে তোলে এবং এগুলো প্রসাবের সাথে নির্গত হয়। এই অবস্থাকেই ডায়বেটিস বলা হয়৷ তাহলে বুঝতেই পারছেন ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ। অনেকের দেহে ইনসুলিন এর ঘাটতি আপেক্ষিক হয়। কোনো কারনে কমে যায়। তাদের ডায়াবেটিস জটিলতাও সাময়িক সময়ের জন্য স্থায়ী থাকে। তবে অনেকের শরীরে ইনসুলিন এর ঘাটতি খুবই বেশি থাকে। তাদের ডায়বেটিস এর জটিলতাও বেশি।
ডায়াবেটিস কেন হয়
আগে ধারনা করা হত শুধুমাত্র বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বর্তমানে সে ধারনার পরিবর্তন হয়েছে। যেকোনো বয়সের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস ধরা পড়তে পারে। তবে কিছু ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস বেশি লক্ষ্য করা যায়। যেমন
- বংশগত ভাবে ডায়াবেটিস এর ঝুঁকিতে আছেন যারা। বিশেষ করে মা -বাবা কিংবা রক্তের সম্পর্কের কারো ডায়াবেটিস থাকলে এমন লোকের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা আছে।
- যারা কোনো শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যয়াম করেন না তাদের ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি রয়েছে
- অতিরিক্ত ওজন আছে এমন ব্যক্তিরাও ঝুঁকিতে আছেন
- দীর্ঘ সময় ধরে যারা কর্টিসোল জাতীয় ঔষধ সেবন করেন
- গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না আসা নারীদেরও স্থায়ী ডায়াবেটিস হতে পারে
- উচ্চরক্তচাপ আছে যাদের এবং রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে নেই তাদেরও ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা আছে
ডায়াবেটিস কয় ধরনের
ডায়াবেটিস অনেক ধরনের হতে পারে। মানুষের বয়স, শারীরিক অবস্থা, জীবনযাপনের ধরনের উপর ভিত্তি করে কয়েক রকমের ডায়াবেটিস শনাক্ত করেছেন গবেষকরা। চলুন সেগুলো জেনে নেই-
টাইপ-১
৩০ বছরের কম বয়সী লোকেদের মধ্যে এই টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেখা যায়। এই রোগীদের শরীর কোন ইনসুলিন তৈরি হয় না বা করলেও খুব সামান্য করে। আর এদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা করে ইনসুলিন নিতে হয়। ডায়াবেটিস এর মাত্রার ভিত্তিতে ইনসুলিন বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে নিতে হয়। ইনসুলিন না নেয়া হলে রক্তের শর্করার পরিমান অনেক বেড়ে যায়। এতে খুব কম সময়ের মধ্যে রক্ত অম্লজাত বিষক্রিয়া হয়৷ ফলে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। দ্রুত ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না আনলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
টাইপ-২
সাধারনত ৩০ বছরের উর্ধ্বে যারা রয়েছেন তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা যায়। এদের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন একেবারে বন্ধ হয়ে যায় না। তবে ইনসুলিন এর মাত্রা কম থাকায় অনেক সময় টাইপ-১ এর মত ইনসুলিন নিতে হয়। তবে ইনসুলিন না নিলেও মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে না। এধরনের রোগীরা ইনসুলিন এর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। এরা চাইলে খাবার নিয়ন্ত্রণ ও হাঁটাচলার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের রাখতে পারেন।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
আজকাল অনেক গর্ভবতী নারীদের ডায়াবেটিস ধরা পরে। গর্ভকালীন এ ডায়াবেটিস অনেক সময় সন্তান প্রসব এর পরপরই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণপ না থাকলে সেটি মা ও শিশু উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এজন্য গর্ভাবস্থায় অনেক নারীদের ইনসুলিন নেয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা।
- অন্যান্য কারণভিত্তিক ডায়াবেটিস
এছাড়াও আরো কিছু আপেক্ষিক কারন থাকে যেগুলোর জন্য ডায়াবেটিস হতে পারে। যেমন
- বংশগত কারনে ইনসুলিন হরমোন কম তৈরী হওয়া
- বংশগত কারনে ইনসুলিন এর কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া
- অন্যন্য হরমোনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়
- অগ্ন্যাশয়ের জটিলতা থাকা
- ওষুধ কিংবা রাসায়নিক দ্রব্যরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
ডায়াবেটিস এর মাত্রা
একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের রক্তের প্লাজমায় খাবার আগে গ্লুকোজের পরিমান ৫.৬ মিলি মোলের এর কম থাকে। এবং খাবার দুই ঘন্টা পরে ৭.৮ মিলি মোলের কম থাকে। তাদের ডায়াবেটিস জটিলতা নেই ধরা হয়।
তবে যাদের রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের মাত্রা খাবার আগে ৭.১মিলি মোলের বেশি এবং খাওয়ার দুই ঘন্টা পরে ১১.১ মিলি মোল বা বেশি হয় তাদের ডায়াবেটিস আছে বলে গন্য করা হয়।
ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হলে কি কি জটিলতা হতে পারে?
অনেকে মনে করেন ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হওয়া তেমন কিছু নয়।এটি শুধু একটি হরমোনাল ইমব্যালেন্স। তবে দূর্ভাগ্যবশত ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা আপনার শরীরে হাজারটা রোগ বালাই এর জায়গা করে দেয়। একবার ডায়াবেটিস ধরা পরলে এর সাথে আরো অনেক জটিলতা দেখা দেয়। আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না আসলে একটার পর একটা জটিলতা বাড়তেই থাকে। ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হলে যেসব জটিলতা দেখা দেয় তা হল-
- হৃদরোগ
- শরীরের পচনশীল ক্ষত
- স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা
- চক্ষুরোগ
- যৌন ক্ষমতা হ্রাস
- কিডনির কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া
- গর্ভপাত, শিশুর জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি
ডায়াবেটিস এর লক্ষন কি কি
ডায়বেটিস এর অতি সাধারণ ও পরিচিত কারণ গুলোর মধ্যে যে সকল কারণ উল্লেখযোগ্য:
ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ
ডায়াবেটিস অর্থাৎ বহুমূত্র রোগের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে ঘন ঘন প্রসাব হওয়া। এছাড়াও প্রসারের বেগ পাওয়া কিন্তু প্রসাব না হওয়া।এটাও ডায়াবেটিস এর লক্ষণ
বার বার ক্ষুধা লাগা
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির বার বার ক্ষুধা লাগা একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। রোগী যথেষ্ট খাওয়ার পড়েও তার খাওয়ার চাহিদা পুরন হয় না। বার বার ক্ষুধা লাগে।
সবসময়ে পিপাসা থাকা
পর্যাপ্ত পানি খাওয়ার পরেও পিপাসা মেটে না। বার বার পিপাসা লাগে। এবং বার বার পানি খাওয়ার কারনেও প্রসাবের বেগও ঘন ঘন তৈরী হয়। বহুমূত্র হবার এটাও একটা কারন।
পরিমিত খাওয়ার পরেও ওজন হ্রাস
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রেগীর ওজন হঠাৎ করেই হ্রাস পেতে পারে। অথবা পর্যাপ্ত খেয়েও ধীরে ধীরে ওজন বাড়ে না। বরং কমে।
অল্প কাজে কিংবা কাজকর্ম ছাড়াই ক্লান্তি বোধ করা
ডায়াবেটিস এর রোগীরা অনেকই শারীরিক ভাবে দূর্বল থাকেন। এ কারনে তারা ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না। এমনকি অল্প কাজ বা কাজ না করেও ক্লান্তি অনুভব করেন। ক্লান্তি অবসাদ বোধ খুবই সাধারণ উপসর্গ।
যেকোনো ক্ষত দেরীতে নিরাময় হওয়া
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি আতংক হচ্ছে ক্ষত নিরাময়ে দেরী হওয়া। যেকোনো ক্ষত, অপারেশন এর সময় এদের রক্ত বন্ধ হতেও জটিলতা তৈরী হয়।
দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া
দৃষ্টিশক্তি দূর্বল হয়ে যাওয়াও ডায়াবেটিস এর লক্ষণ। অনেকের ৩০ বছরের আগেই ডায়াবেটিস এর কারনে দৃষ্টিশক্তি কমে যায় ।
খোসপাঁচড়া জাতীয় চর্মরোগ এর বিস্তার
ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের খোসপাঁচড়া, ফোঁড়া, চর্মরোগ ইত্যাদি দেখা যায়৷ আর এগুলো সহজে নিরাময়ও হতে চায় না।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ
- খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখা
- ঔষধ সেবনে সতর্কতা
- পরিমিত পরিমাণে শারীরিক কসরত করা
- ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা
ডায়াবেটিস তার সাথে করে অনেকগুলো রোগবালাই নিয়ে আসে যা রোগীকে একদম নাজেহাল করে দেয়। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো বিকল্প নেই। ডায়াবেটিস এর কারন, লক্ষণ, এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের জানা উচিত৷ কারন যত দ্রুত এর লক্ষণগুলো শনাক্ত করা যাবে,তত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আশা করি আজকের লেখাটি আপনাদেরকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করবে।