ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? ক্রিপ্টোকারেন্সি আইন

ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency) হলো একধরনের ডিজিটাল কারেন্সি যাকে ভার্চুয়াল মুদ্রা বা গুপ্ত মুদ্রাও বলা যেতে পারে। কেননা এটি হলো এক ধরনের ওপেন সোর্স এবং অদৃশ্য মুদ্রা যার অস্তিত্ব কেবল ইন্টারনেট জগতে রয়েছে। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। আমাদের ব্যবহৃত সাধারণ মুদ্রা বা টাকার মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি ধরা বা ছোঁয়া যায় না এবং বহনও করা যায় না।

এ ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি কোন রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে উৎপাদন করা বা সরবরাহ করা হয় না। এমনকি এসমস্ত ইলেক্ট্রনিক কারেন্সি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও লেনদেনের উপর কোনো ব্যাংক, কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ নেই।

ক্রিপ্টো কয়েনের উৎপাদন, ব্যবহার ও লেনদেন কেবলমাত্র অনলাইন দুনিয়াতেই সম্ভব। ভার্চুয়াল জগতে যে কেউ এ ধরনের ডিজিটাল কয়েন উৎপাদন করতে পারেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারেন ও ব্যবহার করতে পারেন। তবে বেশিরভাগ সময় অনলাইনে বিভিন্ন প্রোডাক্ট ও সার্ভিস ক্রয়-বিক্রয় করার ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোকারেন্সি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।

ক্রিপ্টোকারেন্সি বা এ ধরনের ডিজিটাল কয়েনগুলো মূলত ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় ও লেনদেন করা হয়। এ প্রযুক্তিটি প্রধানত ক্রিপ্টোগ্রাফি বা তথ্যগুপ্তিবিদ্যা ধারণা নিয়ে কাজ করে। এক্ষেত্রে বাইনারি সংখ্যা- শূন্য এবং এক, বিভিন্ন জটিল কোড ও অ্যালগরিদমের সাহায্যে লেনদেনের ডাটা এক একটি ব্লকে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর এই ব্লকগুলো একটির পর একটি সাজিয়ে চেইন গঠন করা হয় এবং এভাবে যে কোড তৈরি হয় সেই কোড দিয়েই এক একটি ক্রিপ্টোকয়েন তৈরি হয়। 

সর্বপ্রথম ১৯৮৩ সালে ডেভিড চৌম নামের একজন মার্কিন গুপ্তলেখক ব্লকচেইনের মাধ্যমে তৈরি “ক্যাশ” নামক এক ধরনের বিশেষ গুপ্তমুদ্রার ব্যবহার ভার্চুয়াল জগতে মানুষের সামনে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে এই ব্যক্তি ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ক্রিপ্টোকারেন্সির আধুনিকায়ন ও অনলাইনে এর লেনদেন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু সে সময় এই ধরনের অদৃশ্য মুদ্রা তেমন জনপ্রিয়তা বা পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। 

পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনলাইন বিষারদ ক্রিপ্টোকারেন্সির ধারণা নিয়ে গবেষণা চালান। তবে ধারণা করা হয়, ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতো নামক এক ব্যক্তি অথবা একটি সংগঠন সফলভাবে এই ডিজিটাল কারেন্সি উৎপাদন ও সরবরাহ করা শুরু করেন। আর অনলাইন জগতে এই কারেন্সির নাম দেওয়া হয় বিটকয়েন।

তবে সময়ের সাথে সাথে আরও অনেক ধরনের ও নামের ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভব ও বিনিয়োগ হলেও এখন পর্যন্ত বিটকয়েন-ই সবথেকে জনপ্রিয় এবং ব্যবহৃত ডিজিটাল টোকেন। এমনকি এই ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমে এখন এটিএম থেকে টাকা তোলা যায়। তবে বর্তমানে ভার্চুয়াল জগতে আরও অনেক ক্রিপ্টোকয়েন লেনদেন ও কেনাকাটার জন্য বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা

ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় একটি অনলাইন ব্যবসা। এ খাতে ইনভেস্ট করে সফল হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে নিতান্তই কম নয়। বরং ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং এর সফলতা ও জনপ্রিয়তার দিকে চোখ রেখে মার্কেটপ্লেসের পরিধি যেমন অসামান্য হারে বাড়ছে তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও আইনি সাপোর্ট বাড়ছে। 

অল্প সময় ও অল্প ইনভেস্টমেন্টে অধিক মুনাফা লাভের জন্য অনেকেই এখন এ খাতে বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখছেন। তবে বিষয়টি যতটা সহজসাধ্য মনে হয় ততটাও সহজ নয়। মিনিমাম ১০০ ডলার বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন ঠিকই তবে টাকার চেয়ে এক্ষেত্রে সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে সবথেকে বেশি।

ক্রিপ্টোতে অর্থ উপার্জন সহ সবকিছুই সঠিক ধারণা দিয়ে শুরু করতে হয়। নীচে আমরা কিছু শীর্ষস্থানীয় ক্রিপ্টো ব্যবসায়িক ধারণা তুলে ধরব যা আপনি এখনই শুরু করতে পারেন৷

Day Trading With Crypto

কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ ক্রিপ্টোকারেন্সি বিজনেস আইডা হলেও এটি এমন একটি উপায় যেখান থেকে যে কেউ সামান্য পরিমাণ টাকা ইনভেস্টের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করতে পারেন এবং লাভবান হতে পারেন। এছাড়া ক্রিপ্টো ব্যবসা শুরু করার জন্য এটি খুবই সহজ একটি উপায়।

প্রাথমিকভাবে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং প্লাটফর্মে সাইন আপ করার মাধ্যমেই বিজনেস শুরু করা যেতে পারে। যারা এই খাতে নতুন তাদের জন্য Coinbase একটি অসাধারণ প্লাটফর্ম। বর্তমানে বিশ্বের 100 টির অধিক দেশ থেকে প্রায় 56 মিলিয়ন ইউজার কয়েনবেজ সফটওয়্যারটির মাধ্যমে ক্রিপ্টো ট্রেডিং করে আয় করছেন। 

Start a Crypto Payment Gateway

ধীরে ধীরে ক্রিপ্টোকারেন্সির চাহিদা ও ব্যবহার বাড়তে থাকায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মুদ্রার মতো ক্রিপ্টো মুদ্রাও এক্সেপ্ট করতে শুরু করেছে। এছাড়া শুধুমাত্র ক্রিপ্টো আর্নিং এর জন্যও অনেক নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে যারা কেবল ক্রিপ্টোর মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে। 

কিন্তু এ ধরনের লেনদেনের জন্য প্রয়োজন একটি লিগ্যাল পেমেন্ট গেটওয়ের। তবে বর্তমানে ইন্টারনেটে এধরনের পেমেন্ট গেটওয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। তাই আপনি যদি সহজে ও নির্ভেজাল ভাবে ক্রিপ্টো ব্যবসা করতে চান তাহলে একটি নিজস্ব ক্রিপ্টো পেমেন্ট গেটওয়ে সিস্টেম চালু করতে পারেন এবং সেখান থেকে ভালো পরিমাণ অর্থ ইনকাম করতে পারেন। এ ধরনের ক্রিপ্টো ব্যবসায় লেনদেনমূলক ফি, সাবস্ক্রিপশন ফি এবং অ্যাকাউন্ট সেট আপ ফি এর মাধ্যমে সহজেই টাকা ইনকাম করা যায়।

Sell Physical Things for Cryptocurrencies Online

বিশ্বজুড়ে বর্তমানে অসংখ্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ইউজার রয়েছেন যারা কেবল ইনভেস্টমেন্ট এর জন্যই নয় বরং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য ও সার্ভিস ক্রয়ের জন্য সাধারণ টাকার মতো ক্রিপ্টো কয়েন ইউজ করতে অধিক আগ্রহী। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে বৈধতা দেন না।

তাই এই ধরনের কাস্টমারদের আপনি আপনার বিজনেসের টার্গেটেড কাস্টমার বানাতে পারেন। আপনি একটি ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করতে পারেন যেখানে পণ্যের কেনাবেচা সাধারণ মুদ্রার পরিবর্তে ভার্চুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে হবে। এরপর এই ভার্চুয়াল মুদ্রাগুলোকে অনলাইন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সাধারণ মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারেন।

এরূপ জনপ্রিয় একটি অনলাইন এক্সচেঞ্জ ওয়েবসাইট হলো Coinbase Commerce. এই প্লাটফর্মে বর্তমানে প্রায় 8,000 এর উপরে সক্রিয় মার্চেন্ট রয়েছেন যারা নিয়মিত এখান থেকে ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ করছেন। সুতরাং আপনি যদি ঝুঁকি মুক্ত ক্রিপ্টো বিজনেস করতে চান তাহলে এটি আপনার জন্য অন্যতম সেরা একটি উপায় হতে পারে অর্থ উপার্জন করার। 

Crypto Freelance Writing

ক্রিপ্টো ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে আয় করার এটি একটি পরোক্ষ উপায়। আপনি যদি ভার্চুয়াল কয়েনের ওপর আপনার মূল্যবান অর্থ বিনিয়োগ করতে অনাগ্রহী হয়ে থাকেন এবং আপনার যদি গবেষণা ও লেখালেখির বিষয়ে দক্ষতা থেকে থাকে তাহলে এই প্রসেসে আপনি ক্রিপ্টো ইন্ডাস্ট্রি থেকে ভালো পরিমাণ টাকা ইনকাম করতে পারেন।

এখানে আপনাকে কোনো টাকা ইনভেস্ট করতে হবে না। অর্থ্যাৎ কোনো কারেন্সি কিনতে বা বেচতে হবে না। ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য নির্ভর ব্লগ ও আর্টিকেল লিখে সেগুলো ওয়েবসাইটে পাবলিশ করার মাধ্যমে টাকা উপার্জন করতে পারেন। ক্রিপ্টোকারেন্সির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় লেখনীর চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই কোন প্রকার টাকা খরচ ছাড়াই কেবল শ্রম ও মেধার মাধ্যমে এভাবে ক্রিপ্টো থেকে আয় করতে পারেন। 

ক্রিপ্টোকারেন্সি স্বিকৃতি প্রদানকারী প্রথম দেশ

ক্রিপ্টোকারেন্সি একধরনের অদৃশ্য ডিজিটাল মুদ্রা হওয়ায় এবং এর উপর কোন দেশের সরকার বা সে দেশের কোন ব্যাংকের নজরদারি না থাকায় সন্ত্রাসবাদে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোকয়েনের নেতিবাচক ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। আর তাই এখন পর্যন্ত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এই মুদ্রাকে স্বীকৃতি প্রদানে অস্বীকার করে।

তবে এর ইতিবাচক দিকগুলো বিবেচনা করে এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে সর্বপ্রথম সালভাদোর নামক একটি দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তাই সালভাদোর ক্রিপ্টোকারেন্সি স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম দেশ হিসেবে সুপরিচিত।

ক্রিপ্টোকারেন্সি আইন

ক্রিপ্টোকারেন্সি শুরুর দিকে তেমন জনপ্রিয় না হলেও বর্তমানে নেট দুনিয়ায় এর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার আকাশ ছোঁয়া। অনলাইনে পণ্য কেনাবেচা ও লেনদেনের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোকয়েনের ব্যবহার থাকলেও, এটি একটি অদৃশ্য বা গুপ্ত মুদ্রা হওয়ায় অনলাইনে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ক্রিপ্টোকারেন্সি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

এছাড়া এ ধরনের ডিজিটাল মুদ্রার উপর যেহেতু কোন দেশের সরকার বা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খবরদারি রাখার কোনো সুযোগ নেই তাই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের সরকার ও সে দেশের উচ্চ আদালত ক্রিপ্টোকারেন্সির উৎপাদন ও লেনদেন আইনগত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

যেমনটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও তাঁর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি জানাতে অসম্মতি জানায় এবং বাংলাদেশে এর লেনদেন অবৈধ ও আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যেকোন প্রকার সাইবার ক্রাইম এবং অপরাধমূলক কাজে আর্থিক লেনদেন বন্ধ করতেই মূলত সরকারের এরূপ সিদ্ধান্ত।

তাই বাংলাদেশ কিংবা দেশের বাহিরে অন্য যেকোন দেশ থেকে ক্রিপ্টো মুদ্রা লেনদেন করার পূর্বে এ সংক্রান্ত সে দেশের আইন সম্পর্কে অবশ্যই জেনে নিতে হবে। নতুবা যে কেউ এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পরতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *