গর্ভবতী মায়েদের জন্য ১০ টি পুষ্টিকর খাবার

একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুর জন্মদানের প্রথম শর্ত কি জানেন? গর্ভবতী মায়ের যথাযথ যত্ন ও পরিচর্যা। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রয়োজন হয় সুষম খাদ্য, সঠিক যত্ন ও সেবা। আর পরিবারের সদস্যরা ই এই সেবা নিশ্চিত করে। পাঁচ মাস থেকে ভ্রুনের বৃদ্ধির জন্য প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন পরে। তার খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, মিনারেল ও পানি থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না কোন খাদ্য গ্রহণে কতটা পুষ্টি পাওয়া যাবে। আর কতটুকু খাওয়াতে হবে। যার কারণে একজন গর্ভবতী মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। গর্ভবতী মায়েদের যত্নে কোন রকম ত্রুটি করা মানে মা ও শিশুর উভয়ের ক্ষতি করা।

তাই আমরা আজকে গর্ভবতী মায়েদের  পুষ্টিকর খাবার নিয়ে আলোচনা করব।

পুষ্টিকর খাবার কোনগুলি

স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবারের তালিকা বৃহৎ। কিন্তু সব খাবার তো সবসময় যোগাড় করা ও খাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিশেষজ্ঞরা এমন কিছু খাবারের তালিকা করেছে যেগুলো পুষ্টি গুনে ভরপুর। মানুষ যেসব খাদ্য গ্রহন করে শরীর সেগুলো হজম ও শোষণ করে। শোষণ করা উপাদান গুলো দেহের কোষের ক্ষয় পুনরুদ্ধার করে এবং দৈহিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। অর্থাৎ যে খাদ্য গ্রহন করার পর পরিপাক হয় এবং সরল উপাদানে পরিনত হয়ে শরীরের চাহিদা পুরন করে সেগুলোই পুষ্টিকর খাবার। শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করতে খাদ্য তালিকায় শর্করা, প্রোটিন, ভিটামিন, ফ্যাট, খনিজ ও পানি রাখতে হবে। 

গর্ভবতী মায়েদের  পুষ্টিকর খাবার কেন প্রয়োজন

সঠিক পুষ্টি ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের দেহ সকল ক্ষয় পুরনে অক্ষম। পর্যাপ্ত পুষ্টি ভ্রূণের বৃদ্ধি ও মায়ের শারীরিক চাহিদা পুরন করে। মায়ের গর্ভে থাকা সন্তান সকল পুষ্টি মায়ের মাধ্যমে পায়। তাই একজন গর্ভবতী মায়ের পুষ্টির সকল চাহিদা পুরন হওয়া দরকার। গর্ভাবস্থায় মায়ের অপুষ্টি থাকলে পরবর্তীতে সন্তান সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিতে পারে না। বিভিন্ন ধরনের অপুষ্টিজনিত রোগ, বিকলাঙ্গতা, প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। অনেক সময়ে জন্মের আগেই গর্ভপাত হয়ে যায়।  তাই একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গর্ভবতী মায়েদের কখন পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে

একজন গর্ভবতীর জন্য প্রথম তিন মাস খুবই ঝুকিঁপূর্ণ সময়। কারণ এসময়ে শরীরে নানা রকম পরিবর্তন আসে। যা অনেকের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তাই সন্তান ও মায়ের সঠিক যত্ন নিশ্চিত করতে তাদের জন্য সুষম খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণত পাঁচ মাস থেকে ভ্রূণের বৃদ্ধি শুরু হয়। এ-সময় থেকেই পুষ্টিকর খাবার শুরু করতে হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য তালিকা তৈরী করে আনা উত্তম।

গর্ভবতী মায়েদের জন্য ১০ টি পুষ্টিকর খাবার

গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রয়োজনীয় এবং হাতের নাগালে পাওয়া যায় এমন ১০টি পুষ্টিকর খাবারের তালিকা এখানে দেয়া হলো:

১.আয়রন সমৃদ্ধ খাবার 

আমাদের দেশের অনেক গর্ভবতী মহিলারা রক্তশূন্যতায় ভুগেন। এসময়ে আয়রন শরীরে হিমোগ্লোবিন ও শক্তি তৈরিতে সাহায্য করে। Institution of Medicine এর মতে, একজন গর্ভবতী মহিলার দৈনিক ২৭ মি.গ্রা আয়রন যুক্ত খাবার খেতে হবে। আর পর্যাপ্ত আয়রন গ্রহণ না করলে এনেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

কচুশাক, পালংশাক, ডিম, কলা, খাসির কলিজা, মুরগীর বাচ্চা, মাছ এসবে প্রচুর আয়রন থাকে।

২.ভিটামিন-এ

WHO এর পরামর্শ অনুযায়ী, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মি.গ্রা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করতে হবে। হাড় এবং অভ্যন্তরীন অঙ্গের বিকাশের জন্য ভিটামিন-এ প্রয়োজন। মুরগির কলিজা, ডিম, গাজর, আম, সবুজ শাক সবজিতে ভিটামিন-এ থাকে।

৩.পটাশিয়াম

শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং শরীরে ফ্লুইড এর ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও পটাশিয়াম হার্টবিট ও এনার্জি লেভেলেনকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। 

কিসমিস, মিষ্টি আলু, ব্রোকলি, মসুর ডাল, টক দই, কমলার জুস ও পালংশাক ইত্যাদি হল পটাশিয়াম যুক্ত খাবার।

৪ জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার 

গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিনমাস জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করতে হবে। জিঙ্ক গর্ভপাতের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও শরীরের বৃদ্ধি, বিভিন্ন অঙ্গে কর্মক্ষমতা যোগাতে জিঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

WHO এর তথ্য অনুযায়ী প্রথম তিনমাস ১১ মিলিগ্রাম,  ২য় তিনমাসে ১৪ মিলিগ্রাম এবং শেষ তিনমাস ২০ মিলিগ্রামের মত জিঙ্ক যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।

চিনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়ার বীজ, প্রানিজ প্রোটিন, গম এসবে প্রচুর জিঙ্ক থাকে।

৫.আয়োডিন যুক্ত লবণ ও খাবার

গর্ভবতী মা যদি পর্যাপ্ত আয়োডিন গ্রহণ না করে তাহলে সন্তানের বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। তাছাড়া আয়োডিন এর অভাবে গর্ভপাত পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত আয়োডিন থাইরয়েড সমস্যা থেকেও মুক্তি দেয়। 

WHO এর মতে, গর্ভাবস্থায় দৈনিক ২০০ মিলিগ্রাম আয়োডিন যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। সামুদ্রিক মাছ, আয়োডিন যুক্ত লবণ, পনির, গরুর দুধ, টক দই খেলে আয়োডিন এর চাহিদা পুরন হয়।

অ্যালোভেরার গুণাগুণ ও উপকারিতা

৬. ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কিংবা খাবার

সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসে শিশুর হাড় ও দাঁতের গঠন তৈরী হয়। এসময়ে শিশুর প্রচুর ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজন হয়। WHO এর পরামর্শ অনুযায়ী, একজন গর্ভবতী মায়ের দৈনিক ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহন করতে হবে আর শেষ তিন মাসে কমপক্ষে ১২০০ মিলিগ্রাম। দুধ, মাছ, শাকসবজি, কমলালেবু, ফুলকপি ইত্যাদিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ মত ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ও সেবন করা যায়।

৭. পর্যাপ্ত প্রোটিন

শরীরের গঠন ও বৃদ্ধিতে প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণ গর্ভাবস্থায় মায়ের অন্য সময়ের তুলনায় বেশি প্রোটিনের প্রয়োজন পড়ে। এসময়ে আমিষ জাতীয় খাবার শিশুর শরীরে নতুন টিস্যু তৈরীর কাজ করে।

গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ গ্রাম প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। ২-৩ টুকরা মাছ, ৩/৪ টুকরা মাংস ও কমপক্ষে একটি ডিম খেলে প্রতিদিনের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হবে। নিয়ম করে প্রতিদিন দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে। কোনো প্রকার কাচা বা অর্ধ সিদ্ধ মাছ, মাংস খাওয়া যাবে না।

৮.ফলিক এসিড

মানব দেহের কোষ বিভাজনের ক্ষেত্রে ফলিক এসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলিক এসিড গর্ভাবস্থায় শিশুর মেরুদণ্ড গঠনে সহায়তা করে। গর্ভাবস্থায় প্রথম কয়েক সপ্তাহে ফলিক এসিডের চাহিদা পুরন হতে হবে। IMO এর ভাষ্যমতে, একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন প্রায় ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড যুক্ত খাবার খেতে হবে। ব্রোকলি, মসুর ডাল, ভাত, কমলা, পাউরুটি ও পালংশাকে প্রচুর ফলিক এসিড আছে।

৯.  ভিটামিট বি-১,বি-২ এবং নায়াসিন

ভিটামিন-বি এর অন্তর্ভুক্ত ছয়টি ভিটামিনের মধ্যে ভিটামিন বি-১ বা থায়ামিন এবং বি-২ অর্থাৎ রিবোফ্লাভিন ও বি-৩ বা নায়াসিন এর চাহিদা গর্ভাবস্থায় বেশি থাকে। ভিটামিন বি বিপাক ক্রিয়া কে সক্রিয় রাখে। ক্লান্তি কমায় ও ত্বকের শুষ্কতা কমিয়ে সতেজ রাখে।

ডিম, কলা, রেড মিট, কিডনি, বিনস, কাঠবাদাম, পালং শাক ও দুধে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন বি পাওয়া যায়।

১০. পানি

এসময়ে প্রচুর পানি পান করতে হবে কারণ পানি শরীরে রক্তকণিকা উৎপাদন করতে সাহায্য করে। এছাড়াও পানি শরীরের অতিরিক্ত ঘাম রোধ করে, মুত্রথলির প্রদাহ কমায়। পানির সাথে বিভিন্ন তরল খাবার যেমন স্যূপ, ফলের রস ইত্যাদি খাওয়া যাবে।

অনাগত সন্তান সকল পুষ্টি পায় মায়ের কাছ থেকে। তাই মায়ের সঠিক যত্ন নেয়ার মাধ্যমেই একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশু জন্ম দেয়া সম্ভব। মা ও শিশুর উভয়ের শারীরিক সকল চাহিদা পুরনের জন্য মায়ের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে হবে তবে অনেকেই সঠিক ভাবে জানেন না কি খাওয়াবে, কখন খাওয়াবে অথবা কতটুকু খাওয়াবে। তাই পরিপূর্ণ যত্নও নিতে পারে না। যা মা ও শিশু উভয়ের ক্ষতি করে। এজন্যই আমরা গর্ভবতী মায়েদের জন্য ১০ টি পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আশা করি আমাদের দেয়া তথ্য গুলো অবশ্যই গর্ভবতী মা ও তার অনাগত সন্তানের জন্য খুবই উপকারী হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *