ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় দুটি পেশা। এই কাজগুলোর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে যেমন আয় করা যায় তেমনি দেশীয় অফলাইন জব সেক্টরগুলোতে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা।
একসময় ওয়েবসাইট ভিত্তিক কাজগুলোর তেমন চাহিদা বা পরিচিতি কোনোটাই ছিলনা। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে ওয়েবসাইট একটি অত্যাবশ্যকীয় ব্যবসায়িক কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন ছোট-বড় প্রায় সবধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এবং অনলাইন উদ্যোক্তাদের রয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইট। আমরা যেমন গুগল, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, অ্যামাজন প্রভৃতি ব্যবহার করি এদের প্রত্যেকেই কিন্তু এক একটি ওয়েবসাইট। এমনকি আপনি এই যে আর্টিকেলটি পড়ছেন, এটিও কিন্তু একটি ওয়েবসাইট থেকেই পড়ছেন।
তাহলে বুঝতেই পারছেন ওয়েবসাইটের প্রভাব ও পরিসর এখন কতটা বিস্তৃত। ঠিক এ কারণেই ওয়েবসাইট ভিত্তিক নানান কাজ যেমন- ওয়েব ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট-এর চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় দক্ষ ওয়েবসাইট ডেভেলপার কিংবা ওয়েবসাইট ডিজাইনারের সংখ্যা অপ্রতুল। তাই সঠিক প্রশিক্ষণ ও চর্চার মাধ্যমে আপনিও একজন Web Designer অথবা Web Developer হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
তাহলে চলুন আর কথা না বাড়িয়ে এবার জেনে নেওয়া যাক ওয়েব ডিজাইন কি, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কি এবং এদের মধ্যে পার্থক্য কি কি?
বিষয় বস্তুসমূহঃ
ওয়েব ডিজাইন কি
ওয়েব ডিজাইন (web design) হলো ওয়েবসাইট ডিজাইনিং (website designing) কথাটির সংক্ষিপ্ত রূপ। এখানে ওয়েব মানে হলো “ওয়েবসাইট” এবং ডিজাইন মানে হলো “নকশা করা” বা “সজ্জিত করা”। অর্থ্যাৎ ওয়েব ডিজাইন মানে হলো ওয়েবসাইটের নকশা তৈরি করা।
সুতরাং বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, “একটি ওয়েবসাইটকে এর ব্যবহারকারীর নিকট আকর্ষণীয়, সহজে বোধগম্য এবং সাবলীলভাবে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য যে নকশা বা চিত্র অঙ্কন করা হয়, সেই প্রক্রিয়ার নামই হলো ওয়েব ডিজাইন।”
একটি ওয়েবসাইট তৈরির পূর্বে প্রথমে এর একটি নকশা ডিজাইন করা হয় এবং পরবর্তীতে সেই চিত্রের ওপর ভিত্তি করে ওয়েব ডেভেলপাররা ওয়েবসাইট নির্মাণ করে থাকেন। আর যারা এভাবে ওয়েব ডিজাইনিং করে থাকেন তাদের বলা হয় ওয়েব ডিজাইনার। এদের কে ফ্রন্টএন্ড ডেভেলোপারও বলা হয়।
একটি ওয়েবসাইট ডিজাইনের ক্ষেত্রে একজন ডিজাইনারের যে সকল দক্ষতার প্রয়োজন হয়ে থাকে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য দক্ষতাগুলো হলো গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ইঞ্জিনিয়ারিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বা এসইও, ফ্রন্ট-এন্ড ওয়েব ডিজাইন, ব্যাক-এন্ড ওয়েব ডিজাইন এবং ইন্টারফেস ডিজাইন।
এই বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে একজন ডিজাইনার তার দক্ষতা এবং পরিকল্পনার নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট এবং ইউনিক ডিজাইন তৈরি করে থাকেন। যার উপর ভিত্তি করে একজন ডেভেলপার সেটিকে একটি গাঠনিক রূপ দেন।
এভাবে প্রতিটি ওয়েবসাইটের-ই ভিন্ন ভিন্ন গঠনশৈলি দেখা যায়। যেমন- আমরা যে ফেসবুক এবং গুগল ব্যবহার করি এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা গঠনশৈলি। ফেসবুক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে এর ডিজাইন যেমন আলাদা প্রকৃতির তেমনি গুগল একটি সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে এর নকশা-নমুনাও ভিন্ন ধরনের।
এভাবে প্রতিটি ওয়েবসাইটকে তার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে ডিজাইনারগণ রং, ছবি এবং কাঠামো দিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে একটি ওয়েবসাইটের চিত্র অঙ্কন করার এবং টেমপ্লেট (template) তৈরি করার চেষ্টা করেন এবং সেই ডিজাইন অনুসরণ করে পরবর্তীতে সেটি তৈরি করা হয়।
ওয়েব ডিজাইন শিখতে কতদিন লাগে
ওয়েব ডিজাইন শিখতে কতদিন লাগে তা নির্দিষ্টভাবে কখনও-ই বলা সম্ভব না। কেননা যে বিষয়টি আপনি ১০ দিনে শিখতে পারেন সেটি শিখতে হয়তো আমার ২০ দিনও লাগতে পারে।
অর্থাৎ এটি শিখতে কতদিন লাগবে এই সম্পূর্ণ বিষয়টি আপনার একাগ্রতা, প্রচেষ্টা, চর্চা এবং মেধার উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। তবে আপেক্ষিকভাবে বলতে গেলে ওয়েব ডিজাইনিং এর যেই মৌলিক বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো আয়ত্ত করতে কম করে হলেও ২-৩ মাস পর্যন্ত লাগতে পারে। ওয়েবসাইট ডিজাইন শেখার বেসিক বিষয়গুলো হলো:
- HTML
- CSS
- JavaScript
- Photoshop
এগুলো শেখার পর আপনি যদি ওয়েব ডিজাইনের আরও গভীরে জানতে চান তাহলে ৫-৬ মাস আপনাকে স্টাডি করতে হতে পারে। এরপর নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে এক থেকে দেড় বছরের মাঝে নিজেকে আপনি একজন দক্ষ ওয়েব ডিজাইনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
বিঃদ্রঃ এই সময়সীমা কেবলমাত্র একটি রেগুলার প্রসেসের জন্যই গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ কেউ যদি এটি শেখার ক্ষেত্রে অনিয়মিত হন যেমন- কেউ HTML শিখে 2-3 মাসের গ্যাপ দিয়ে আবার CSS শিখছেন তবে এক্ষেত্রে কখনও একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া সম্ভব না। আপনি কত দ্রুত ওয়েব ডিজাইন শিখবেন সেটি কেবল আপনার ইচ্ছা ও পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল।
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কি
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট হলো ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে বর্তমান সময়ের সবথেকে বেশি চাহিদাসম্পন্ন একটি কাজ। ওয়েবসাইট ব্যবহারের প্রবণতা যেহেতু প্রতিনিয়ত বাড়ছে, সেহেতু ওয়েবসাইট রিলেটেড কাজগুলো-ও ব্যাপক সারাজাগানীয়। যাদের মধ্যে web development উল্লেখযোগ্য।
এখানে ওয়েব (web) অর্থ হলো “ওয়েবসাইট” (website) এবং ডেভেলপমেন্ট (development) অর্থ হলো “বিকাশ লাভ করা”। তো এভাবে বলতে গেলে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট মানে হলো ওয়েবসাইটের বিকাশ সাধন করা।
একটি ওয়েবসাইট বিভিন্নভাবে বিকশিত হতে পারে। যেমন- ওয়েবসাইটটি তৈরি করা, আপডেট করা, তথ্য আপলোড করা, অর্ডার করা, অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা, ডাটাবেজ তৈরি করা, রেজিস্ট্রেশন করা প্রভৃতি।
অর্থ্যাৎ এককথায় বলতে গেলে, একজন ওয়েব ডিজাইনার ওয়েবসাইটের যেই ডিজাইন তৈরি করেন সেই ডিজাইন বা টেমপ্লেট অনুযায়ী ওয়েবসাইটের একটি গাঠনিক রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া-ই হলো ওয়েব ডেভেলপমেন্ট (website development).
ওয়েবসাইটকে কেবল গাঠনিক রূপ দেওয়াই নয় বরং ওয়েবসাইটে নতুন নতুন ফিচার যুক্ত করা বা পুরাতন কিছু মুছে ফেলাও ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট এর মধ্যে গণ্য হবে।
আর যিনি ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট করেন তাকে ওয়েব ডেভেলপার (web developer) বলা হয়। একজন ওয়েব ডিজাইনারও ওয়েব ডেভেলপার হতে পারেন। এজন্য তাকে ওয়েব ডিজাইনিং শেখার পাশাপাশি ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট-ও শিখতে হবে।
তবে web design শেখা থাকলে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট শেখা অনেক সহজ হয়ে যায় এবং তা আয়ত্ত করতে সময় কম লাগে। কেননা website designing শেখার খাতিরে ইতিমধ্যে HTML, CSS, JAVASCRIPT প্রভৃতি জানা হয়ে যায়।
কিন্তু ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর কাজ করতে হলে আরও বিশেষ কিছু কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা (programming language) জানা থাকতে হবে। যেমন- JAVA, SQL, PHP, PYTHON ইত্যাদি। তবে আপনি কখন কোন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজটি ব্যবহার করবেন তা নির্ভর করবে আপনি কোন কাজটি করবেন তার ওপর।
ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর মধ্যে পার্থক্য
ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও ওয়েব ডিজাইন- টার্ম দুটি ওয়েবসাইট সম্পর্কিত হলেও এরা এক নয়। ইতিমধ্যে আমরা ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কি সে সম্পর্কে জেনেছি। এখন আমরা জানবো এদের মধ্যে কি কি পার্থক্য রয়েছে সেগুলো।
ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এর মধ্যে পার্থক্য:
- ওয়েব ডিজাইন হলো একটি ওয়েবসাইটের টেমপ্লেট বা নকশা তৈরি করা। পক্ষান্তরে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট হলো ঐ ডিজাইন বা নকশাকে ডায়নামিক করা অর্থ্যাৎ সক্রিয় করা।
- যিনি ওয়েব ডিজাইনের কাজ করেন তিনি হলেন ওয়েব ডিজাইনার। আর যিনি ওয়েব ডেভেলপমেন্ট করেন তিনি হলেন ওয়েব ডেভেলপার।
- ওয়েব ডিজাইনিং এর জন্য সাধারণত HTML, CSS, এবং JavaScript সম্পর্কে ধারণা থাকলেই চলে। অপরদিকে ওয়েব ডেভেলপিং করতে হলে HTML, CSS এবং JAVASCRIPT এর পাশাপাশি আরও অন্যান্য প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ যেমন- JAVA, MySQL, PHP, Python প্রভৃতি অবশ্যই জানা থাকতে হবে।
- একজন ওয়েব ডিজাইনারকে ডিজাইন তৈরি করতে যেমন ক্রিয়েটিভ হওয়া আবশ্যক তেমনি গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহারের দক্ষতা থাকতে হবে।অন্যদিকে একজন ওয়েব ডেভেলপারের টেকনিক্যাল জ্ঞানের পাশাপাশি সার্ভার (server) রিলেটেড বিভিন্ন বিষয় যেমন- ASP.NET, AJAX, Database প্রভৃতি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে।
- একটি ওয়েবসাইটের মূলত প্রধান তিনটি অংশ রয়েছে। ডিজাইন বা টেমপ্লেট তৈরি, কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ডাটাবেজ তৈরি। একজন ওয়েব ডিজাইনারের কাজ কেবল একটি সাইটের ডিজাইন বা টেমপ্লেট তৈরি করা। অপরদিকে একজন ওয়েব ডেভেলপারকে ওয়েবসাইটের তিনটি অংশকেই ডেভেলপ করতে হতে পারে।
- ওয়েব ডিজাইন অনেক কম সময়ের মাঝে শেখা সম্ভব। পক্ষান্তরে web development শিখতে হলে দীর্ঘ সময় এবং প্রোপার ট্রেনিং অত্যাবশ্যক।
তো এই ছিল ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যগুলো। তবে এই বিষয়গুলো খুবেই সাধারণ এবং গভীর কিছু নয়।
কেননা কাজের প্রতি কারো যদি শতভাগ ডেডিকেশন থাকে তাহলে সে সহজেই দুটি বিষয়েই একসাথে শিখতে পারেন এবং করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাকে বলা হবে একজন ফুলস্টাক ওয়েব ডেভেলপার। অর্থ্যাৎ তিনি ওয়েব ডিজানিং করতে পারেন এবং ডেভেলপিং-ও করতে পারেন।
আমাদের ইতিকথা
ওয়েব ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কি এবং এদের মধ্যে কি কি পার্থক্য রয়েছে সে সম্পর্কে আমরা এই আর্টিকেলে বিষদভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনারা এই বিষয়গুলোর যথাযথ উত্তর পেয়ে থাকবেন।
এরপরেও যদি আপনাদের কোন কিছু বুঝতে অসুবিধা হয় অথবা web design সম্পর্কে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে আমাদের অবগত করবেন। আমরা আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।