নানান ধরনের জাঙ্ক ফুড খেয়ে আমাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। সম্প্রতি সময়ে ডায়াবেটিস নামক রোগ আমাদের অসতর্কতার জন্য শরীরে দানা বাঁধছে। ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার কোন ঔষধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতার কারনে আমরা এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে ডায়াবেটিস একবার হলে তা আর সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়না। এককথায় জীবনের সকল স্বাদ আহ্লাদ একদম মাটি হয়ে যায়। যাহোক, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শুধু ঔষধের উপর নির্ভর না করে জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমাদের আজকের পোস্টে আমরা ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে জানবো। উপায় গুলো ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ করলে আমরা ডায়াবেটিস নামক অভিশাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবো।
ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার অনেক গুলো উপায় আছে। চলুন পর্যায়ক্রমে সেগুলো যেনে নেওয়া যাক।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
ব্যায়াম করা
শরীরচর্চা সকল রোগের ঝুঁকি কমায়। কারন শরীরচর্চার কারনে শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং হরমোনাল ব্যালেন্স স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। ব্যায়াম করার কারনে শরীরের চর্বি কমে যায় এবং হৃদপিণ্ড স্বাভাবিক ভাবে কাজ করে। ডায়াবেটিস হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায় এবং দেহ বিভিন্ন রোগের জন্য আদর্শ বাসস্থান হয়ে ওঠে। কিন্তু ব্যায়াম করার কারনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। নিয়মিত ব্যায়াম একই সাথে শরীর এবং মন দুটোই সতেজ এবং স্বাস্থ্যকর রাখে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না এই কথা আমরা সকলেই জানি। শরীর এবং স্বাস্থ্য এই দুই বিষয়েও এর গুরুত্ব আছে। যেমন আপনি যদি অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করেন তাহলে আপনার শরীরে চর্বি জমবে, আপনার ওজন বাড়তে থাকবে এবং আপনি সবসময় অসুস্থ থাকবেন। কিন্তু আপনি যদি অতিরিক্ত ব্যায়াম করে আপনার ওজন একদম কমিয়ে আনেন তাহলে আবার হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। বেশি ওজন কমালে আপনার শরীর দুর্বল হয়ে যাবে, শক্তি কমে যাবে এবং আপনি আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন। অতএব আপনাকে আপনার শরীরের ওজন সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আপনি BMI পদ্ধতি ইউজ করে দেখতে পারেন। এতে আপনি বয়স এবং উচ্চতার উপর নির্ভর করে সঠিক ওজন জানতে পারবেন।
লাল আটা খাওয়া
বলা হয়ে থাকে যে সাদা আটা খেলে ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি বাড়ে। যদিও বাজারে সাদা আটার প্রচলন সব থেকে বেশি কিন্তু ডায়াবেটিস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলে সাদা আটা খাওয়া বাদ দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে লাল আটা অনেক ভালো একটি বিকল্প। লাল আটা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে অনেক বড় ভুমিকা পালন করে।
পরিমিত খাবার গ্রহণ
আমরা জানি প্রতিটি খাবারের পুষ্টিগুণ আছে। আমাদের শরীর সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য পরিমিত এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত। একবারে অনেক গুলো খাবার না খেয়ে কিছু সময় বিরতি দিয়ে অল্প অল্প করে খাবার গ্রহণ করলে তা শরীরের জন্য সবথেকে বেশি উপকারী।
ফাস্ট ফুড বর্জন
ফাস্ট ফুড হলো রোগ তৈরির আড্ডাখানা। কারন ফাস্ট ফুডে অনেক বেশি পরিমাণ ফ্যাট থাকে যা শরীরের জন্য বিষ সমান। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড গ্রহণ করার কারনে দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমে, ওজন বেড়ে যায়, শরীরে পুষ্টির তারতম্য সহ আরও অনেক সমস্যা তৈরি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ফাস্ট ফুড একদম পরিহার করা সব থেকে ভালো।
শাক সবজি খাওয়া
সুস্থ শরীরের জন্য শাক সবজি একটি আদর্শ খাবার। বিশেষ করে সবুজ খাবার (সবুজ ফল এবং শাক সবজি) শরীরের সব থেকে উপকারী খাবার। কারন এসকল খাবারে সকল ধরনের ভিটামিন বাদেও জিংক, আয়রন, মিনারেল সহ অনেক পুষ্টিগুণ থাকে। নিয়মিত শাকসবজি গ্রহনের ফলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে ডায়াবেটিস সহ অন্যান্য সকল রোগ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়।
পরিমিত ঘুম
ঘুম মানব শরীর এবং মনের জন্য উপযুক্ত একটি বিশ্রাম নেওয়ার পদ্ধতি। মানুষ যখন ঘুমায় তখন তার শরীর এবং মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়। পরিমিত ঘুমের কারনে শরীর এবং মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণ হরমোনাল কেমিক্যাল ডিস্ট্রিবিউট হয়। এতে শরীর এবং ব্রেইন পুনরায় কাজ করার শক্তি পায়। সঠিক পরিমাণ ঘুমের কারনে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক পর্যায় থাকে। এতে ডায়াবেটিস সহ অন্যান্য রোগ থেকে নিরাপদ থাকা যায়।
মানুষিক চাপমুক্ত থাকা
মানুষিক চাপ মনের সাথে সাথে দেহের শান্তি নষ্ট করে দেয়। মানুষিক দুশ্চিন্তা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস সহ অন্যান্য রোগের অন্যতম কারন। অতএব এসব থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হলে সবসময় মানুষিক চাপ মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
বেশি বেশি পানি পান করা
পানি শরীরের সকল কোষকে সতেজ এবং কর্মক্ষম রাখে। আমাদের দেহের মোট ১০০ ভাগের ৭০ ভাগ হলো পানি। শরীর পরিচালনায় রক্তের পরেই পানির স্থান। পরিমিত পানি পান করলে শরীর রোগের সাথে লড়াই করার শক্তি পায়। বেশি বেশি পানি পান করার কারনে বিভিন্ন রোগ থেকে আমাদের শরীর মুক্ত থাকে।
দারুচিনি যুক্ত খাবার গ্রহণ
জার্মান এক গবেষণায় বলা হয়েছে যে দারুচিনি নামক মশলা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞান সকল ধরনের মশলা কম খাওয়ার পরামর্শ দেয় তবে দারুচিনি এবং লবঙ্গ ডায়াবেটিস সহ অনেক রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।
হাই কোলেস্টেরল খাবার বর্জন
কোলেস্টেরল দেহের জন্য অনেক খারাপ একটি উপাদান। এটি ধমনীতে চর্বি জমায় এবং স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে বাঁধা প্রদান করে। ডায়াবেটিস বাদেও অন্যান্য রোগের জন্য কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার পরিহার করা প্রয়োজন।
ধূমপান বর্জন
ধূমপান আর মদ্যপান যাই বলিনা কেন তা শরীরের জন্য একদম উপকারী নয়। দেহের ক্ষতি করা ছাড়া এদের আর কোন কার্যকারিতা নেই। ধূমপানের কারনে ফুসফুস যেমন নষ্ট হয়ে যায় তেমনি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। অন্যদিকে মদ্যপানের কারনে পাকস্থলী এবং কিডনি সহ মস্তিষ্কের অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সয়া যুক্ত খাবার গ্রহণ
সয়া যুক্ত খাবার অনেক হাই প্রোটিন যুক্ত হয়ে থাকে। পরিমিত পরিমাণ সয়া প্রোটিন শরীরের পুষ্টিগুণ নিয়ন্ত্রণ করে। এতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন বাড়তে থাকে তেমনি ডায়াবেটিস সহ অন্যান্য রোগ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ
সাধারনত শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিত সুগার থাকার কারনে আমরা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হই। কিন্তু আমরা যদি রিস্ক না নিয়ে রুটিন মোতাবেক আমাদের জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করি তাহলে আমাদের শরীরে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমবে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এতে শরীরের কন্ডিশন বোঝা যায়। কোথায় কি সমস্যা আছে এবং সে সমস্যা সমাধানের উপায় খুজে বের করা যায়। দেহে কখন কিসের অভাব আছে বা কোন পুষ্টিগুণ কম বা বেশি আছে নাকি তা জানার জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরী। বিশেষ করে ডায়াবেটিস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত বিরতিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অনেক বেশি প্রয়োজন। কারন ডায়াবেটিস হওয়ার আগে প্রতিরোধ করা সম্ভব কিন্তু একবার হয়ে গেলে তখন আর নিজেকে সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়না।
ডায়াবেটিস আবিষ্কার হওয়ার পর ১৯৮০ সালের জরীপ অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মোট রোগী ছিল ১০৮ মিলিয়ন। অন্যদিকে ২০১৪ সালের জরীপ অনুযায়ী সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২২ মিলিয়ন রোগীতে। এই সংখ্যা দিন দিন পুর বিশ্বজুড়ে বেড়েই চলছে। তাই এখনি সময় এই মরণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই আমাদের নিজেদের সতর্ক হয়ে চলতে হবে। আশাকরি এই লেখা পড়ে ডায়াবেটিস থেকে বাঁচার সকল উপায় গুলো জানতে পেরেছেন। ডায়াবেটিস নিয়ে কোন কিছু জানার থাকলে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন ধন্যবাদ।