পেটের গ্যাসে প্রায় মানুষই ভোগে থাকে। তবে গ্যাস অন্যান্য রোগের মতো কোন কঠিন বা মরণব্যাধি রোগ নয়। গ্যাস বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে অতিরিক্ত তেল, ভাজাপোড়া এবং প্রয়োজনের থেকে কম পানি পান করার ফলে মূলত পেটে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। গ্যাস হলে অনেক সময় পেট ফাপা, পেট ফোলা ও ঢেকুড় ওঠা এবং পেট ও বুক ব্যথা করে। অনেক সময় পেটের গ্যাসের জন্য খাওয়ার রুচি কমে যায়। তবে গ্যাস থেকে খুব সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়।
বিষয় বস্তুসমূহঃ
পেটের গ্যাস কি
পেটের গ্যাস সাধারণত অন্যান্য রোগের মতো একটি রোগ। এই রোগে যারা ভোগে তারাই জানে এর যন্ত্রণা কেমন। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত ও তেলযুক্ত খাবার ও ভাজাপোড়া খাবার খেলে পেটে গ্যাস সৃষ্টি হয়। মানুষ অনেক সময় হঠাৎ করে অথবা অনিচ্ছাকৃত কারণে বাতাস গিলে ফেললে পেটে বায়ুর সৃষ্টির হয় ও পেটে গ্যাসের তৈরি হয় এবং গ্যাস হলে অনেক সময় বমি বমি ভাব হয়। গ্যাস হলে পেট ব্যথা করে, আবার অনেক সময় বুকও ব্যথা করে। দেহে পেটের অঙ্গগুলোতে অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা খাবার হজমে কাজ করে। খাদ্য হজমের পর এগুলোই নাইট্রোজেন, মিথেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস তৈরি করে। এসব গ্যাস গন্ধ মুক্ত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া সালফার সমৃদ্ধ গ্যাস উৎপন্ন করে যা দূর্গন্ধযুক্ত।
পেটের গ্যাস হওয়ার কারণ
বিভিন্ন কারণে পেটে গ্যাস হয়ে থাকে এবং পেট ব্যথ্যা করে। প্রায় প্রত্যেকেই এই সমস্যায় ভুগে থাকে এবং এটি অনেক যন্ত্রণাদায়ক। বেশিভাগ মানুষেই প্রতিদিন প্রায় ১০/১৫ বার ঢেকুর বা বায়ুর মাধ্যমে গ্যাস বের করে। আবার অনেকের অতিরিক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয়। পেটে গ্যাস হওয়ার কারণ উল্লেখ করা হলো:
বেশি বাতাস প্রবেশ করলে
যে কোনভাবে পেটে বাতাস প্রবেশ করলে গ্যাসের সৃষ্টি হয় এবং আপনি যে গ্যাসই বের করেন না কেন সেটি কোন না কোনভাবে অন্ত্রের নিকট পৌছে যায় এবং আপনি যখন মুখ দ্বারা শ্বাস নিয়ে থাকেন তখনও এটি হতে পারে। অন্ত্রের কিছু পরিমাণ গ্যাস জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে তৈরি যা সেখানে বাস করে থাকে। আপনি যদি অত্যাধিক পরিমাণে গ্যাস পান, তাহলে এর কারণ হতে পারে তা হলো আপনি অধিক মাত্রায় শ্বাস নিয়ে ফেলেছেন। তাহলে সেটি কিছু পরিমাণ গ্যাসের মাধ্যমে বের হয় আর কিছু ঢেকুরের মাধ্যমে।
কার্বোনেটেড পানীয়
সোডা, বিয়ার, কোন বুদবুদ জাতীয় পানীয় হতে গ্যাস উৎপন্ন হতে কাজ করে। যদি আপনার গ্যাসের সমস্যা থাকে আর যদি কার্বোনেটেড পানীয় পান করতে পছন্দ করেন তাহলে এগুলোর পরিবর্তে সাধারণ পানি পান করুন, তাহলে নিজেই তফাৎ টা অনায়াসে বুঝতে পারবেন। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কার্বোনেটেড পানীয় এড়িয়ে চলুন।
খাদ্যভাসের কারণে
কিছু খাবারের ফলে পেটের গ্যাস সৃষ্টি হয়। যেমন- শাক, ব্রকলি, সাইলিয়ামযুক্ত ফাইবার জাতীয় খাবার, রাজমা ও সবুজ শস্যযুক্ত খাবার গ্যাস তৈরি করে। ছোলা ও মটরশুটি প্রায় ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে খেলে গ্যাস কম হয়। আবার অনেক সময় খাবার সঠিকভাবে হজম হয় না এবং আঠালো দ্রব্য ও দুগ্ধ খাবার খেলেও পেটের গ্যাস তৈরি হয়।
খারাপ অভ্যাস
কিছু অভ্যাসের ফলে মুখে অতিরিক্ত বাতাস প্রবেশ করে। যেমন- যে কোন শক্ত ক্যান্ডি বা চুইংগাম চিবানোর সময় বেশি বাতাস গ্রাস করে ফেলেন, আবার জলদি খাওয়ার কারণে ও স্ট্রয়ের সঙ্গে পান করার স্বভাব গ্যাসের সৃষ্টি করে। যদি আপনার কলম চিবানোর স্বভাব থাকে তাহলে আপনি অবশ্যই অতিরিক্ত বাতাস গ্রহণ করছেন যেটি গ্যাস আকার বের হয়ে আসে।
ধীরে হজম বা কোষ্ঠকাঠিন্য
কোন কারণে যদি আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য হয় ও খাদ্য আস্তে আস্তে অন্ত্রে প্রবেশ করে তবে এটি গ্যাস তৈরিতে সুযোগ বেশি দিয়ে থাকে। খাবার পেটে দীর্ঘ সময় থাকলে জীবাণুও দীর্ঘ সময় বিদ্যমান থাকে, যার কারণে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হজম শক্তি হ্রাস পায়, যা গ্রাস গঠনে সহায়তা করে এবং কিছু ওষুধ ও কৃত্রিম মিষ্টি গ্যাস তৈরি করে।
ঘুমের সময় মুখ খোলা রাখা
ঘুমের সময় নাক ডাকলে অথবা মুখ খোলা রেখে শ্বাস নিলে সারারাত প্রচুর পরিমাণে বাতাস অনাযাসে গ্রহণ করতে পারেন, যার ফলে গ্যাস হতে পারে।
পেটের গ্যাসের ওষুধ
রেনিটিডিন হলো পেটের গ্যাসের চিকিৎসায় বহুল প্রচলিত একটি ঔষধ। সাধারণত পেটে গ্যাসের সমস্যায় প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রেনিটিডিন গ্রহণ করা বা খাওয়া যায়। রেনিটিডিন ছাড়াও গ্যাস নিরাময় করতে আরো বিভিন্ন প্রকার ঔষধ বাজারে প্রচলিত রয়েছে, যেগুলোর সাহায্যে গ্যাস কমানো যায়। যেমন- ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, এন্টারসিড এবং রাবিপ্রাজল।
উল্লিখিত ঔষধ গুলো প্রায় একই রকমভাবে গ্যাসের কাজ করে। তবে দীর্ঘদিন সেবন করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
পেটের গ্যাস কমানোর উপায়
যারা পেটে গ্যাসের সমস্যায় ভুগে থাকেন শুধু তারাই বুঝে এর কতো যন্ত্রণা। ভাজাপোড়া খেলে বা ভাজাপোড়া বেশিই খেয়ে ফেললে তখনই শুরু হয়ে যায় অস্বস্তিকর গ্যাস। তবে গ্যাসের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া তেমন বেশি কঠিন কোন কাজ নয়। গ্যাস থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজের খাওয়া দাওয়ার দিকে নজর রাখতে হবে এবং গ্যাস তৈরি হয় এমন ধরনের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
গ্যাস এড়িয়ে চলতে যেসব খাবার খাবেন না এবং যেগুলো খাবেন সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
যা যা খাবেন না
- ডাল জাতীয় খাবার: বুট, ছোলা, ডাল, সয়াবিন ইত্যাদি জাতীয় খাবার হতে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। কারণ এগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুগার, ফাইবার ও প্রোটিন যা সহজে খাদ্য হজম করতে চায় না। যার কারণে পেটে গ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি করে।
- বাধাঁকপি, ফুলকপি, ব্রকলি: ফুলকপি, ব্রকলি, বাধাঁকপি এই সমস্ত সবজিগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে ‘রাফিনোজ’ নামক সুগার উপাদান। যা মানুষের দেহে পাকস্থলীর ব্যাকটেরিয়া উত্তেজিত না করা পর্যন্ত হয় না। যার জন্য এই অবস্থায় পেটে গ্যাসের সমস্যা বাড়তে থাকে।
- দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার: দুধ জাতীয় খাবার খাওয়ার পরে যদি আপনি অনুভব করেন যে পেটে গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে তাহলে বুঝতে হবে যে আপনার দুধযুক্ত খাবারে হজমে সমস্যা রয়েছে। মূলত খাবার হজম না হলে পেটে গ্যাস তৈরি করে এবং এগুলোই গ্যাসের জন্য দায়ী।
- পেয়ারা ও আপেল: পেয়ারা ও আপেলে ফাইবার এবং সরবিটোল নামক সুগার উপাদান রয়েছে যা সহজে হজম প্রক্রিয়া চালাতে চায় না, আর এর জন্য গ্যাস হয়।
- লবণাক্ত খাবার: লবণে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম রয়েছে এবং এটি পানিগ্রাহী। অতিরিক্তলবাণ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয় এবং লবণাক্ত খাবার খেলে শরীরে পানি জমার সমস্যাও দেখা দেয় এবং পাকস্থলীতে সমস্যা সৃষ্টি হয় ও খাবার হজম হতে বাধাঁ দেয়, সহজে হজম হতে চায় না।
যা যা খাবেন
- আদা: আদা খেলে গ্যাস দ্রুত কমতে সহায়তা করে এবং সবচেয়ে বেশি কার্যকরী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান সমৃদ্ধ। পেটে গ্যাস ও পেট ফাঁপা হলে আদা কুচি করে লবণ দিয়ে কাঁচায় চিবিয়ে খেলে অনেক বেশি উপকার হয় এবং দেখবেন গ্যাসের সমস্যা অনায়াসে সমাধান হয়ে যায়।
- শসা: শসা পেটের চর্বি কমাতে যেমন কাজ করে তেমনি পেট ঠাণ্ডা রাখতে এটি বেশ কার্যকরী খাদ্য। শসায় রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ও ফ্লেভানয়েড উপাদান যা পেটে গ্যাস হ্রাস করে এই খাবার।
- কমলা ও কলা: প্রতিদিন একটি কলা খেলে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়, তাছাড়া কলা ও কমলা পাকস্থলীর অতিরিক্ত সোডিয়াম দূর করতে সাহায্য করে এবং গ্যাসের সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়।
- দই: দই ঠান্ডা জাতীয় খাবার এবং দই আমাদের হজম শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দই খুব দ্রুত খাবার হজম করতে কাজ করে, যার ফলে পেটে গ্যাস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং গ্যাসের ঝামেলা দূর হয়।
- পেপেঁ: পেঁপেতে পাপায়া নামক এক ধরনের এনজাইম রয়েছে হজমশক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে এবং নিয়মিত পেঁপে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেও গ্যাসের সমস্যা কমে যায়।
গ্যাসের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। শুধু নিজের খাওয়া-দাওয়ার প্রতি ভালোমত নজর রাখলে গ্যাস হতে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
প্রাকৃতিকভাবে গ্যাস কমানো উপায়:
শুধুমাত্র ঔষধই গ্যাস কমায় এমনটা নয় বরং প্রাকৃতিক উপায়েও গ্যস কমানো সম্ভব। ঘরোয়া পদ্ধতিতে কিছু উপায় রয়েছে যেগুলোর প্রয়োগ করে যন্ত্রণাদায়ক গ্যাস দূর করা সম্ভব। যেমন-
- পানি: প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান করুন। প্রথমে যদি বেশি পানি খেতে না পারেন সেক্ষেত্রে অল্প করে বা এক গ্লাস করে পান করুন এবং পরে ধীরে ধীরে পানি বেশি করে খাবেন। এতে পেটের গ্যাস অনায়াসে দূর হবে। এভাবে আপনি ৩/৪ সপ্তাহ পানি পান করলে এর পার্থক্য বুঝতে পারবেন।
- জিরা: পেটের গ্যাস দূরীকরণে জিরা অত্যন্ত কার্যকারী উপাদান। আখের গুড়ের সঙ্গে ৫০ গ্রাম জিরা গুড়া বানিয়ে ভালো করে মিশিয়ে ১০ গ্রাম করে ৫/৬টি বড়ি তৈরী করে নিন এবং এগুলো দিনে তিনবার নিয়ম করে খেলে গ্যাসের যন্ত্রণা থেকে খুব সহজে মুক্তি পেয়ে যাবেন।
- দারুচিনি: দারুচিনি হজমের জন্য খুবই কার্যকরী প্রাকৃতিক একটি উপাদান। প্রতিদিন এক গ্লাস গরম পানিতে অর্ধেক চামচ দারুচিনির শরবত বানিয়ে ২ থেকে ৩ বার পান করলে গ্যাস কমতে থাকবে।
- মধু-আদা: আদা বেটে রস করে খাঁটি মধুর সাথে আদার রস মিশিয়ে একটি মিশ্রণ নিয়মিত দুপুর ও রাতের আহারের পূর্বে খেয়ে নিন। আর যতটা সম্ভব অল্প পরিমাণ আদা লবণ দিয়ে চিবিয়েও খেতে পারেন, এতে গ্যাস কমে যাবে।
- কলা: কলা শরীরের ক্লান্তি দূর করতে সহায়তা করে। প্রতিদিন অন্তত দুইটি কলা খান। কলা খাদ্য পরিপাক ও পেট পরিষ্কার রাখতে কলা অধিক কার্যকারী।
- ঠান্ডা দুধ: আমরা সচরাচর গরম দুধ পান করে থাকি এবং গরম দুধ পান করতে ভালো লাগে। কিন্তু ঠান্ডা দুধ পাকস্থলির গ্যাস নিয়ন্ত্রণ খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
উপরোক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, গ্যাস তেমন কঠিন রোগ নয়। খাবারের প্রতি নজর রাখলে গ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ। তাই খাবারের প্রতি সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। প্রদিন বেশি বেশি পানি পান করতে হবে এবং তেল ও ভাজাপোড়া খাবার খাবার কম খেতে হবে।