ডায়াবেটিস সারানোর উপায়

বর্তমানে খুবই সাধারণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হল ডায়াবেটিস৷ এটি মূলত বিপাকজনিত সমস্যা। ইনসুলিন নামক হরমোন উৎপাদন কমে গেলে শরীরে থাকা গ্লুকোজ গুলো ভাঙ্গতে পারে না। এই অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলা হয়।  এর ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে, কারন ডায়াবেটিস এর সাথে আরো অনেক রোগবালাই শরীর জায়গা করে নেয়। ডায়াবেটিস রোগের উপরে করা একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে,  ১৯৮০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে   সাড়ে ৩শ মিলিয়নের বেশি ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। 

আর ডায়াবেটিস এর স্থায়ী কোন চিকিৎসা নেই। অর্থাৎ এটি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিয়মমাফিক জীবনযাপন, সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তাই আমারা আজকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সেই উপায় গুলো সম্পর্কে জানব।

ডায়াবেটিস কি

ডায়াবেটিস হল এমন একটি রোগ যেখানে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান অনেক বেশি থাকে। কারন আমাদের শরীরের স্বাভাবিক বিপাকক্রিয়া পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ইনসুলিন নামক হরমোন এর। কিন্তু অনেক সময়ে কোনো কারণবশত এই হরমোনের উৎপাদন  যদি স্থায়ী বা আপেক্ষিক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখনই রক্তে থাকা গ্লুকোজ গুলো না ভেঙে শরীরে জমা হয়। এবং এভাবে সুগারের পরিমাণ বাড়তে থাকে। বংশগত, পরিবেশগত ও জীবনযাত্রার ধরনের কারনে ডায়াবেটিস হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি সাধারণ রোগ মনে হলেও, ডায়াবেটিস এর সাথে অনেক রোগবালাই শরীরে বাসা বাঁধে। 

ডায়াবেটিস পরীক্ষা 

রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয়ের মাধ্যমে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমান খাওয়ার আগে ৩.৩ মিলি মোল থেকে  ৫.৬ মিলি মোল এর মধ্যে থাকে। আর খাওয়ার দুই ঘন্টা পরে ৭.৮ মিলি মোল এর কম গ্লুকোজ থাকে।

কিন্তু কারো যদি খাওয়ার আগে ৭ -৭.১ মিলি মোল ও খাওয়ার দুই ঘন্টা পরে ১১ মিলি মোল এর বেশি থাকে তখন তার ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়। 

ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিসের লক্ষণ সমূহ

ডায়াবেটিস মাপার নিয়ম

অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে ডায়াবেটিস কখন মাপবেন,কতবার মাপবেন।  আসলে ডায়াবেটিস মাপার জন্য,   আপনার ডাক্তার কর্তৃক পরামর্শ নেওয়াও উত্তম। তবে সাধারণত টাইপ – ১ ও টাইপ – ২ দুইধরনের ডায়াবেটিস এর জন্য মাপার নিয়ম আলাদা আলাদা।  

  • টাইপ-১ ডায়াবেটিস যাদের আছে তারা দিনে ৪ থেকে ১০ বার মাপবেন। এটা আপনার চিকিৎসকই আপনাকে বলে দিবে সঠিক সংখ্যা।  সাধারণত খাওয়ার আগে ও পরে,ব্যায়ামের আগে ও পরে, ঘুমানোর আগে ও শেষ রাতে। এই সময় গুলোই সাজেস্ট করেন।
  • টাইপ – ২ ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে সপ্তাহে কমপক্ষে তিন-চার দিন মাপতে হবে। এই নিয়ম যারা ইনসুলিন গ্রহন করেন তাদের জন্য প্রযোজ্য। 

ডায়াবেটিস সারানোর উপায়

ডায়াবেটিস রোগটি পুরোপুরি নির্মূল হবে এমন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নি। 

তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেও আপনি একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মত জীবনযাপন করতে পারবেন। এজন্য ডায়াবেটিস সারানোর উপায় বা এর প্রকোপ কমানোর উপায় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। 

ডায়াবেটিস সারাতে হলে সুগার কন্টোল করতে হবে। আর সুগার কন্টোল করা বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। এগুলোই মূলত ডায়াবেটিস সারানোর উপায়। এছাড়া স্থায়ী কোনো সমাধান নেই। সুগার নিয়ন্ত্রণ করেই সুস্থ থাকা সম্ভব। 

ডায়বেটিস এর চিকিৎসা 

রক্তে যখন সুগারের পরিমান বেড়ে যায় তা বিভিন্ন উাপায়ে কন্ট্রোল করা যায়। যেমন-

ইনসুলিন ব্যবহার

একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের শরীরের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ সঠিক মাত্রায় থাকে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগী আর সুস্থ মানুষের এটাই পার্থক্য। ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে ইনসুলিন নামক বিপাকজনিত হরমোন উৎপন্ন হয় না। এটাই মূলত রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে। এর উৎপাদনে ঘাটতির কারনেই রক্তের সুগার (গ্লুকোজ)  নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এজন্য ডায়াবেটিস রোগীদের  বাইরে থেকে ইনসুলিন নেয়া উত্তম। এটি রক্তের সাথে মিশে রক্তের গ্লুকোজকে ভাঙতে সাহায্য করে। এবং এভাবেই ইনসুলিন ডায়াবেটিস রোগীদের সুগার কমায় ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে। তবে ডায়াবেটিস এর ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা মাত্রার ইনসুলিন নিতে হয়।

কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স জনিত খাবার গ্রহন

রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করার আরেকটি কার্যকরী উপায় হচ্ছে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স জনিত খাবার খাওয়া। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে রক্তের সুগার রোলার ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। 

এভাবে ডায়াবেটিস রোগীরা তাদের সুগার কন্টোল করে রাখতে পারেন। ডায়াবেটিস এর স্থায়ী চিকিৎসা না থাকলেও এভাবে সুগার কন্টোল করে সুস্থ থাকা সম্ভব।

ডায়াবেটিস এর খাদ্য সর্তকতা 

ডায়াবেটিস এর কারন হচ্ছে রক্তে অনিয়ন্ত্রিত সুগার।  আর খাদ্যাভাস পরিবর্তন করে বা খাবার গ্রহনে সচেতন হয়ে এই সুগার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 

আপনার চিকিৎসকই আপনার খাদ্য তালিকা আপনাকে বলে দেবে।  তবে সাধারণ যে খাদ্য তালিকা সবার জন্য প্রযোজ্য তা হল-

  • যারা দৈনিক মাঝারি পরিমাণে পরিশ্রম করেন তারা প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৩০ ক্যালরি খাবার গ্রহন করবেন।
  • মোট ক্যালরির ৪০-৫০ ভাগ খাবারে শর্করা জাতীয় খাবার থাকবে
  • আটা, ডাল, ঢেঁকিছাটা চাল, বাদাম, শিমের বিচির মত জটিল শর্করা গ্রহন করতে পারবেন
  • মোট ক্যালরির ১৫-২০ ভাগ প্রোটিন রাখতে পারবেন।
  • চিনি, মধু,মিষ্টি, গুড়, ডালডা, চর্বিযুক্ত মাংস, কলিজা, গলদা চিংড়ি, ভাজা খাদ্য ইত্যাদি খাবার পরিহার করবেন বা কম খাবেন। অন্য খাদ্যের মাধ্যমে এসব খাদ্যের চাহিদা পুরন করবেন।

ডায়াবেটিসের ঔষধ

ডায়াবেটিসের ওষুধের ধরন দুটি। মুখে খাবার ঔষধ এবং ইনসুলিন।  আপনার চিকিৎসাই আপনাকে বলে দেবে আপনার জন্য কোনটি উত্তম। শুধুমাত্র খাবার নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক পরিশ্রম করেও অনেকের শরীরের সুগার নিয়ন্ত্রণে আসে না। এই ধরনের রোগীদের মূলত ঔষধ সেবন করার পরামর্শ দেয়া হয়৷ মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটি সঙ্গে করে আরো রোগ বালাইয়ের আবির্ভাব ঘটায়। তাই নিজে নিজে কোন ঔষধ খাবেন না। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। নয়ত যেকোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

ডায়াবেটিস কমাতে শরীরচর্চা

একজন ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে। চাইলে জিমে গিয়ে নিয়মমাফিক ব্যয়াম করা যায়। অথবা বাসায় বসে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যায়াম করা যায়। তবে অনেকের বয়স বেশি হওয়ার কারনে, কিংবা অন্যান্য সমস্যা থাকার কারনে ভারী ব্যয়াম করা সম্ভব হয় না। তারা চাইলে নিয়মিত হাটাঁহাটি করে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তবে কখন কখন হাঁটবেন তার একটি রুটিন করে নিতে হবে। সকালে, বিকালে অথবা সন্ধ্যায় বা রাতে হাঁটা যায়। ৪০ মিনিটে ৩০ মাইল যেতে পারবেন এই গতিতে হাঁটবেন। সপ্তাহে কমপক্ষে ৫ দিন হাঁটবেন।

সাঁতার,  সাইক্লিং বা একটু ভারী ব্যায়ামও উপকারী। তবে বয়স ও শারীরিক অবস্থা ভেদে এই ব্যয়ামের পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে শৃঙ্খলা 

ডায়াবেটিস রোগীর সুস্থ জীবনের প্রধান উপায় হচ্ছে  জীবনধরনে শৃঙ্খলা। রোগীকে সকল ধরনের নিয়মকানুন মেনে জীবনযাপন করতে হবে। তাহলেই সুস্থ থাকা সম্ভব হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের রোগের ধরন ভেদে কিছু নিয়মকানুন থাকে। তবে সাধারণ কিছু বিষয় সকলকে মাথায় রাখতে হবে।  সেগুলো হল-

  • পরিমান মত সুষম খাদ্য গ্রহন করতে হবে
  • নিয়মিত ব্যায়াম কিংবা শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে
  • প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে
  • ডায়াবেটিস নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ সেবন করা যাবে না

গবেষকদের ধারনা, এই ডায়াবেটিস খুব দ্রুত সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য সেবায় বড় একটি ঝুঁকি বয়ে নিয়ে আসবে। প্রতি ১১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাহলে এর ভয়াবহতা কতটুকু তা ধারনা করতেই পারছেন? ডায়াবেটিসে মৃত্যু হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হয়। কিন্তু ডায়াবেটিস এর কারনেই অনেক রোগবালাই এ আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছেন। তাই আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। আমরা আপনাদের সামনে ডায়াবেটিস সারানোর উপায়, এর চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তুলে ধরেছি। আশাকরি এসব দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে আপনিও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *