গর্ভবতী মায়ের পাঁচটি বিপদ চিহ্ন

গর্ভাবস্থা অন্য যে কোন সময়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ এটি সুস্থ সন্তান জন্মদানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আর এইসময়ে গর্ভবতী মায়ের দিকে সর্বক্ষণ খেয়াল রাখতে হয়। কারণ মা এর সাথে সন্তানের সবকিছু সংযুক্ত থাকে। খাদ্য, দৈহিক বৃদ্ধির উপাদান, শক্তি, প্রয়োজনীয় পুষ্টি সবকিছু মায়ের কাছ থেকে পায়। মায়ের যত্নের ত্রুটি করা মানে সন্তানের জন্মদানে ঝুঁকি সৃষ্টি করা। তাই গর্ভবতী মায়ের সুবিধা, অসুবিধা, বিপদচিহ্ন ইত্যাদির দিকে সব সময় নজর রাখতে হবে।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে মা ও শিশু মৃত্যুর হার বেশি। যদিও আগের থেকে কমিয়ে আনা  হয়েছে। তবে এই ধারা বজায় রাখতে হলে আরো বেশি সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্যের বিষয় গুলো সবাইকে জানতে হবে। গর্ভবতী মায়ের কোনো আকস্মিক বিপদ যেন না হয়, সে জন্য আমরা গর্ভবতী মায়ের পাঁচটি বিপদ চিহ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

গর্ভাবস্থায় কোন সময়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ

অনেকেই একটি প্রশ্ন সবসময় করেন যে, গর্ভাবস্থায় কোন সময়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? আসলে সম্পূর্ণ গর্ভাবস্থা ই গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই একজন গর্ভবতী মায়ের পুরো গর্ভকালীন সময়কেই গুরুত্ব দেয়া হয় এবং বিশেষ নজর দেয়া হয়। তবে যেহেতু গর্ভবতী মায়ের বিভিন্ন স্টেজে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়, তাই প্রতিটি স্টেজে আলাদা আলদা যত্ন নিতে হয়। সন্তানসম্ভবা হওয়ার প্রথম তিন মাস নতুন শারীরিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে সময় লাগে। তাই এ সময় টা বিশেষ যত্ন সহকারে পার করতে হয়। আর সন্তান ভূমিষ্ট হবার আগের কয়েকটি মাসও খুবই জটিল। কারণ এসময়ে নতুন কিছু শারীরিক পরিবর্তন আসে। মোট কথা একজন গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন প্রতিটি স্টেজকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

গর্ভবতী মায়ের কি কি জটিলতা দেখা দিতে পারে

গর্ভবতী মায়ের অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। এগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। গর্ভাবস্থায় একজন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে দেখা যায় এমন  কিছু শারীরিক জটিলতা হল-

  • ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মায়েরা কোমড় ব্যথায় ভোগেন। ওজন বৃদ্ধির কারনে কিংবা অস্থির শিথিলতার কারনে এমনটা হয়ে থাকে। 
  • কোষ্ঠকাঠিন্য গর্ভাবস্থায় মহিলাদের একটি সাধারণ সমস্যা।
  • ঘন ঘন প্রসাব হওয়া, পেট শক্ত হয়ে আসা
  • মূত্রনালীর প্রদাহ ইত্যাদি। 

গর্ভবতী মায়ের পাঁচটি বিপদচিহ্ন

গর্ভবতী মায়ের কিছু বিপদচিহ্ন থাকে সেগুলো সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা থাকা অতি জরুরি। তাই আমরা এমন ৫ টি বিপদ চিহ্ন সম্পর্কে জানবো:

হঠাৎ রক্তপাত

সন্তান প্রসবের সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক রক্তপাত হয়ে থাকে। তবে এর আগে যদি গর্ভাবস্থার কোন সময়ে রক্তপাত শুরু হয় সেটি অবশ্যই ভয়ের কারণ। এছাড়াও অনেকে প্রসবের সময়ে স্বাভাবিক এর থেকে অনেক বেশি রক্তপাত হয়। এমনকি গর্ভফুল না পড়াও একটি বিপদের লক্ষন। এ সকল জটিলতা মূলত রক্ত জমাট বাঁধতে দেরী হওয়ার কারণে হয়ে থাকে। তাই সন্তান প্রসবের আগে গর্ভবতী মায়ের থ্রম্বোপ্লাস্টিন পরীক্ষা করে নিতে হয়। তাছাড়া সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তপাত হলে সেটা সন্তানের জন্যও অনেক বেশি ঝুকিপূর্ণ। তাই হঠাৎ রক্তপাত কিংবা অতিরিক্ত রক্তপাতের মত বিপদ চিহ্ন দেখা দিলে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসককে জানাতে হবে।

চোখে ঝাপসা দেখা কিংবা তীব্র মাথা ব্যথা

গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পরে অনেক গর্ভবতী মায়ের শরীরে পানি জমতে দেখা যায়। এসময়ে যদি প্রচুর মাথাব্যথা হয় কিংবা চোখে ঝাপসা দেখে তাহলে এটাও একটি বিপদের লক্ষণ। মায়েদের এ ব্যপারে সচেতন থাকতে হবে। তীব্র মাথা ব্যথা কিংবা চোখে ঝাপসা দেখলে সাথে সাথে কাউকে জানাতে হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

খিচুনি

গর্ভকালীন সময়ে বা প্রসবের সময়ে খিচুনি খুবই খারাপ একটি লক্ষণ। এটি মূলত এলকামসিয়ার উপসর্গ। হঠাৎ খিচুনি ওঠা মা ও শিশু উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই গর্ভবতী মায়ের খিচুনি লক্ষ্য করলে সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। দেরী হয়ে গেলে মা ও শিশুর জন্য মৃত্যু বয়ে আনতে পারে আকস্মিক খিচুনি।

প্রসবে দেরী হওয়া

সন্তান প্রসবের আগে স্বাভাবিকভাবে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হয়। তবে এই ব্যথা ১২ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হওয়া মোটেও স্বাভাবিক নয়। এছাড়া প্রসবের সময়ে বাচ্চার মাথা আগে না বের হয়ে অন্য কোন অঙ্গ বের হওয়াও ঝুঁকির বিষয়। তাই ডাক্তাররা সব সময়ে হাসপাতালে প্রসব করানোর পরামর্শ দেন।

জ্বর 

গর্ভাবস্থায় প্রচন্ড জ্বর বা প্রসবের পরও তিনদিন পর্যন্ত জ্বর স্থায়ী হওয়া খুবই খারাপ লক্ষণ। অতিরিক্ত জ্বর ও প্রসাবের সময়ে জ্বালাপোড়া মূত্রনালীর সংক্রমণের লক্ষন। তাই এই বিপদ চিহ্ন দেখা দিলে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে জানাতে হবে। 

বিপদ থেকে রক্ষা পেতে গর্ভবতী মায়ের কি কি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে

গর্ভকালীন ঝুকি থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমাদেরকে কিছু ‍নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলো হলো: 

তলপেটে ব্যথা

তলপেটে ব্যথা হওয়া বড় কোনো বিপদ চিহ্ন নয়। কিন্তু এটি পরবর্তীতে কোন বিপদের উপসর্গ হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় প্রথম তিনমাসের মধ্যে তলপেটে অতিরিক্ত ব্যথা অনুভব করলে ডাক্তারকে জানাতে হবে এবং ব্যথার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে। তলপেটে ব্যথা বিভিন্ন ধরনের রোগের উপসর্গ হতে পারে। জরায়ুর টিউমার, মূত্রনালীর সংক্রমণ, যৌনরোগের কারণেও ব্যথা হতে পারে। তাই সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে। 

রক্তচাপ 

গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ সবসময় স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হবে। এজন্য সপ্তাহে অন্তত দুইবার গর্ভবতী মায়ের রক্তচাপ মাপতে হবে। কারণ উচ্চ রক্তচাপের কারণে অনেক ধরনের জটিলতা তৈরী হয়। গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ একলামসিয়ার একটি প্রধান লক্ষণ। তাই রক্তচাপ সবসময় স্বাভাবিক রাখতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

বাচ্চার নড়াচড়া 

বাচ্চার নড়াচড়ার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই গর্ভবতী মাকে সবসময়ে বাচ্চার নড়াচড়ার দিকে নজর রাখতে হবে। সাধারনত ১৬ – ২০ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করা যায়। বাচ্চার নড়াচড়া নির্দিষ্ট একটি সময় ও গতি থাকে। এর অনেক বেশি তারতম্য হলে মা সোটি বুঝতে পারেন। আর অতিরিক্ত নড়াচড়া বা কম নড়া দুটোই ঝুকিঁপূর্ণ। তাই ডাক্তারকে এ বিষয়ে অবশ্যই জানাতে হবে।

ডায়াবেটিস

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বাচ্চার ওজনের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই ডায়াবেটিস এর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

ডায়াবেটিস সারানোর উপায়

গর্ভাবস্থা সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা

  • অনেকের ধারণা গর্ভবতী মা কোনো প্রকার ভ্যাকসিন নিতে পারবেন না। এতে মা ও শিশুর ক্ষতি হয়। কিন্তু সঠিক তথ্য হল গর্ভবতী মায়ের ইমিউন সিস্টেমে কিছু পরিবর্তন আসে। তাই এসময়ে ফ্লু হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফ্লু ভ্যাক্সিন নেয়া যাবে।
  • আরেকটি ভুল ধারনা হয় গর্ভবতী মায়েরা সাধারণ মানুষের মতই খাবার খাবেন, অতিরিক্ত খাবারের দরকার নেই। কিন্তু একজন গর্ভবতী মায়ের আসলে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে এবং খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে।
  • অনেকে বলে থাকেন গর্ভাবস্থায় মাছ খাওয়া যাবে না। আসলে ৬ মাসের গর্ভবতী মায়েদের জন্য সামুদ্রিক মাছ নিষেধ হলেও অন্যান্য মাছ খাওয়া যাবে। মাছে থাকা ওমেগা-৩ যুক্ত ফ্যাটি এসিড শিশুর ব্রেনের বিকাশে খুবই কার্যকরী।

গর্ভাবস্থায় মা ও শিশু উভয়ে খুব নাজুক অবস্থায় থাকে। কারণ ছোট ছোট যত্নের উপরে তাদের জীবন-মৃত্যু নির্ভর করে। তাই গর্ভবতী মায়ের প্রতিটি মুহুর্তে যথাযথ খেয়াল রাখতে হবে। যে কোন আসন্ন বিপদ থেকে আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। একজন গর্ভবতী মায়ের একার পক্ষে নিজের সব খেয়াল রাখা সম্ভব না। তাই পরিবারের সদস্যদের এই সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ছোট কোন উপসর্গ থেকে বড় কোন বিপদ ঘটে যেতে পারে। এজন্যই গর্ভবতী মায়ের পাঁচটি বিপদ চিহ্ন তুলে ধরা হয়েছে। যেন গর্ভবতী মা ও অনাগত সন্তান যে কোন আকস্মিক বিপদ থেকে রক্ষা পায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *